Monday 16 November 2015

টেবিল টেনিস, অথবা নিছক ভুতের গল্প

সেটা ১৯৯৭ সালের কথা, তখন জলপাইগুড়িতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি প্রথম বর্ষে। বসন্ত কাল, পরীক্ষা-টরীক্ষা নেই কাছেপিঠে, হাতে তাই অফুরন্ত সময়। যারা প্রাকৃতিক দৃশ্য ভালবাসে, আমাদের ক্যাম্পাসটা তাদের জন্যে সোনায় সোহাগার মত। উত্তর দিকটা জুড়ে ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগান, সেদিকে তাকালে যতদুর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ, আর বাগানের বুক চিরে চলে গেছে রেললাইন উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর দিকে। পশ্চিম জুড়েও চাবাগান দুরে, তার আগে করলা নদীর ওপর রেলব্রিজ। ক্যাম্পাসের পশ্চিম আর পূর্ব দিক দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে করলা আর রুকরুকা দুই নদী। বসন্তকালে চা বাগানের দিক থেকে বয়ে আসে দারুন মৃদুমন্দ হাওয়া, উত্তর দিকে ডুয়ার্স আর তার ওপরে পূর্ব হিমালয়ের হাতছানি নিয়ে। যে রাতটার হাড় হিম করা ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা এখন লিখতে যাচ্ছি তার জন্যে এই বসন্ত কালের পরিবেশ ছিল আদর্শ পটভূমিকা।
আমাদের এক নম্বর হোস্টেলের একতলায় উত্তরের দিকে ছিল একটা বড় কমন রুম, যেখানে হোস্টেলের সবাই সময় কাটাতে আসত। কমন রুমে ছিল একটা কালার টিভি, গোটা তিন ক্যারাম বোর্ড আর সেই লিস্টে নতুন আমদানি একটা ঝাঁ চকচকে টেবিল টেনিস বোর্ড। কমন রুমের দরজার উল্টোদিকের দেয়ালে, টিভি স্ট্যান্ডের পাশে আরেকটা ছোটমত দরজা। সেই দরজার পেছনে একটা ছোট্ট ঘর, আমরা বলতাম নিউজ রুম। সে ঘরে ছিল খালি একটা দেয়াল জোড়া বড় টেবিল আর দুপাশে দু সারি বেঞ্চি। নিউজ রুমের পেছনের দেয়াল জুড়ে খড়খড়ি দেয়া জানলা, যেখানে তাকালে তিন নম্বর হোস্টেলের রাস্তা তার পর থেকে চা বাগান শুরু। নিউজ রুমটা ছিল হোস্টেলের পড়ুয়া ছেলেদের খবরের কাগজ পড়ার জায়গা। ঘরটা খোলা হতো ১২টা থেকে ৪-৫টা অবধি, শনি রবিবার আরেকটু আগে থেকে। তবে খুব বেশি লোকজন যে ব্যগ্র ছিল সারা বিশ্বের খবর জানার জন্যে তা বললে ভুল হবে। ঘরটা বেশির ভাগ সময় ফাঁকাই থাকত।
যে সালটার কথা বলছি সে বছর টেবিল টেনিস খেলার একটা ধুম পড়েছিল হোস্টেলের ছাত্রদের মধ্যে। স্পোর্টস ফান্ডের টাকায় এলো নতুন বোর্ড, তার সাথে বেশ কিছু নতুন ব্যাটও। আমরা ফার্স্ট ইয়াররা থাকতাম থার্ড ইয়ারের ছেলেদের সাথে, কাজেই কমন রুমে একটা অলিখিত নিয়ম ছিল যে থার্ড ইয়ারের ছেলেরা খেলা, টিভির সামনে সিট এসবে প্রথম চান্স পাবে। টেবিল টেনিসেও তাই লম্বা লাইন পড়ত খেলার জন্যে, সেখানে থার্ড ইয়ারের ছেলেদেরই অগ্রাধিকার, যদিনা কেউ দয়া করে ফার্স্ট ইয়ারের কুচোকাঁচাদের একটা গেম খেলতে দিতো। ফার্স্ট ইয়াররা খেলার চান্স পেত রাতের দিকে যখন সিনিয়াররা পরের দিনের সেশনাল বা ব্রিজের আসর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। আমার রুমমেট ছিল তথা – তথাগত বামুন, আমরা দুজনেই টেবিল টেনিস খেলার জন্যে খুব উৎসাহী ছিলাম কিন্তু রোজ রোজ অনেক রাত অবধি অপেক্ষা করেও খুচরো এদিক ওদিক এক-আধটা গেম ছাড়া কপাল খোলেনি। আমাদের তিন নম্বর রুমমেট বিক্রম ছিল তুখোড় টেবিল টেনিস খেলুড়ে তাই শেখার গরজটা আমাদেরই  বেশি ছিল। 
ঘটনার সূত্রপাত এরকমই এক রাতে যখন আমরা ঠিক করলাম যে যথেষ্ট হয়েছে সেই রাতে এসপার-ওসপার হয়ে যাবে। পরদিন ক্লাস থাকা সত্ত্বেও ঠিক করলাম যত দেরিই হোক না কেন সে রাতে কমন রুম ফাঁকা হওয়া অবধি অপেক্ষা করব তারপর টানা যতক্ষণ ইচ্ছে প্র্যাকটিস চালিয়ে যাব। প্ল্যান যে কাজ করছে সেটা বোঝা গেল সাড়ে এগারোটা নাগাদ কমন রুম ফাঁকা হতে শুরু করায়। ক্যারম বোর্ডের আলোগুলো একে একে নিভতে শুরু করলো, বোর্ড ঢাকা পড়ল নেভি ব্লু কভারে। টিভি তখনও চলছিল তবে দেখার লোক বলতে গোটা দুই। হাতে গোনা কয়েকজন ফার্স্ট ইয়ার রয়ে গেলাম টেবিল টেনিস খেলার জন্যে। প্রতিটা গেমের পর অন্যদের সাথে হাত বদল করছিলাম কিন্তু সবাই আনাড়ি তাই একটা গেম পাঁচ দশ মিনিটও টিকছিল না। রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ শেষ জুড়ি ঘুমোতে চলে গেল, রয়ে গেলাম তথা আর আমি। ফাঁকা কমন রুম, টেবিল টেনিস বোর্ডের মাথার ওপর টিমটিম করে জ্বলা আলো, আলো-আঁধারী তার মাঝে চুটিয়ে শুরু হলো দুই আনাড়ির টেবিল টেনিস প্র্যাকটিস।
ঠকাঠক ঠকাঠক। ব্যাট আর বলের আওয়াজ প্রথমে কানে না আসলেও খানিকক্ষণ পর শব্দটা একঘেয়ে বিরক্তিকর লাগতে শুরু করলো। অনেকে বলে টেবিল টেনিস খেলাটা সবচেয়ে কঠিন, রিফ্লেক্স খুব ধারালো না হলে এ খেলা রপ্ত করা কঠিন। কিছুক্ষণ খেলার পর সেটা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করলাম। হাত পা শরীরচর্চার অভাবে ঝনঝন করছে, তবু জেদের বশে চলতে থাকলো রেলি। ঘড়ির কাঁটাগুলো একবগ্গা ঘুরে ঘুরে সময় বয়ান করতে লাগলো একটা দেড়টা দুটো, আমাদের খেলার উৎসাহে ক্ষান্তি পড়লনা তবুও। নিশিগ্রস্ত মানুষদের মত আমি আর তথা চালিয়ে যেতে লাগলাম সার্ভ স্লাইস স্ম্যাশ। আমি খেলছিলাম কমন রুমের পেছনের দেয়ালের দিক থেকে, আর তথা ছিল দরজার দিকে। আমি যতবার জিতছিলাম রেলিতে বলটা গড়িয়ে গড়িয়ে কমন রুমের বাইরে চলে যাচ্ছিল তাই দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আবার শুরু হলো প্র্যাকটিস।
আমাদের একঘেয়েমি ভাঙলো তথা সার্ভ করতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ানোয়। ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে ও আমার পেছনের দেয়ালের দিকে কিছু একটা দেখছে। একে এত রাত তার ওপর সময় নষ্ট, জিজ্ঞাসা করলাম
 – কিরে সার্ভ করছিসনা কেন? থামলি কি কারণে?
চোখ না সরিয়ে তথা উত্তর দিল
– মনে হলো কিছু একটা যেন নড়ছিল ঐ দরজাটার দিকে।
তথার আঙ্গুল নিউজ রুমের দরজার দিকে নির্দেশ করছে।
– ধুর ওখানে আবার কি নড়বে। পোকামাকড় হবে। 
– তাই হবে। হয়ত ল্যাম্পের আলোটা কোথাও রিফ্লেক্ট করে চোখে পড়েছে। 
আবার শুরু করলাম খেলা কিন্তু ঠিক করলাম যে তিনটে গেম খেলব কে জিতবে ঠিক করার জন্যে, তারপর রুমে ফিরে যাব। 
প্রথম গেমের মাঝপথে তথা একটা স্ম্যাশ মারলো, সেটা ফেরাতে পারলামনা, বলটা গড়িয়ে চলে গেল কমন রুমের পেছন দিকে, টিভি আর নিউজ রুমের কোনটায়। বল কুড়িয়ে ফিরে আসছি হঠাৎ চোখ তুলে তথার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। ও আবার আমার পেছনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে, চোখ বিস্ফারিত খানিকটা বিস্ময় খানিকটা আতঙ্ক জুড়ে ওর মুখে চোখে। ছোটবেলা থেকে গাদা গুচ্ছের বই পড়ে পড়ে রজ্জুতে সর্পভ্রম আমার স্বভাব, তাই ছোটখাটো ঘটনাকেও মনে মনে তিলকে তাল করে ভয় পাওয়া আমার কাছে নতুন কিছু নয়। তবু সেই রাত্রে তথাকে ওভাবে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনটা ছ্যাঁত করে উঠলো আমার। যতই ঘাবড়ে যাইনা কেন, এই মুহূর্তগুলোতে অ্যাড্রিনালিন শরীরকে হঠাৎ সজাগ করে দেয়। সময় থমকে দাঁড়ায় সব ঘটনাবলী বিচার করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ানোর জন্যে। মাথা তখন লজিক খুঁজতে শুরু করে, অলীক কান্ডকারখানায় তার তখন কোনো আগ্রহ নেই। সেরকমই সেই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে তথার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম 
– কিরে আবার কি হলো?
– নিউজ রুমের তালাটা নড়ছিল।
– ধুর কি যা তা বলছিস।  তালা আবার নড়বে কি করে? আলো রিফ্লেক্ট করেছে সেটাই দেখেছিস হয়ত। 
ভেবেছিলাম তথা বলবে আমার পেছনে কেউ ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সেটা বললে প্রাণ খাঁচাছাড়া হয়ে যেত। ও যখন বলল তালা নড়ছে, মনে আবার স্বস্তি ফিরে পেলাম। তালা আবার কি নড়বে! খানিক বীরপুরুষের মত যাচাই করে দেখার জন্যে ফিরে গেলাম দরজার কাছে। নতুন স্টেনলেস স্টিলের তালা দরজার কড়া থেকে ঝুলছে। নড়াচড়ার কোনো চিহ্ন নেই। তবে হ্যাঁ টেবিল টেনিসের টেবিল থেকে এদিকটা দেখতে যেমন লাগছিল এখন দরজার সামনে আলো আঁধারীতে দাঁড়িয়ে চারপাশের অন্ধকারটা যেন একটু বেশিই গাঢ় মনে হচ্ছে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার কোনো ইচ্ছেই নেই ওই ভুতুড়ে ছায়া আবছায়া ঘেরা কোনে, তাই তথাকে হেঁকে বললাম 
– দেখ তালা যে কে সেই কিচ্ছু নড়ছেনা এখানে। ভুল দেখেছিস। চল এই গেমটা শেষ করে শুতে যাই, অনেক রাত হলো। 
তথাও দেখলাম নিশ্চিন্ত যে চাক্ষুষ যাচাই করে নিয়েছি আমরা তালা নড়ছেনা।
ফেরার জন্যে সবে দুই পা বাড়িয়েছি হঠাৎ তথা বেশ জোরে অথচ আতঙ্কগ্রস্ত চাপা গলায় বলে উঠলো 
– হনু ওই আবার নড়ছে। 
এত চেষ্টা চরিত্র করে মনটাকে যে শান্ত করেছিলাম সেটা আবার নিমেষে উধাও হয়ে গেল। যেন ছুরিওলা আততায়ী আবার আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। গায়ের তো সব লোম খাড়া হয়ে গেছে ঘামে ভেজা হওয়া সত্ত্বেও। নাড়ি দৌড়চ্ছে উর্ধশ্বাসে, তবু কোনমতে মনে জোর এনে আবার বললাম 
– নড়ছে মানে? ইয়ার্কি মারছিস না তো এত রাতে?
– মাকালীর দিব্যি।  ওই দেখ আবার নড়ছে তালাটা সরে আয় তাড়াতাড়ি। 
এটা শুনেই হাড় হিম হয়ে গেল আমার। কমন রুমে খালি আমি আর তথা দুজনেই পনের বিশ ফুট দুরে যখন তথা প্রথম বার দেখতে পেয়েছিল। তালাটা যদি নিজে নিজে নড়ে তাহলে সেটা যে ভৌতিক কান্ড তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তা সত্ত্বেও পালাবার আগে একবার দেখে নেয়ার উৎকন্ঠা সামলাতে পারলামনা। পেছন ঘুরে দাঁড়ালাম নিউজ রুমের দরজার সামনে। তালা আবার আগের মত ঝুলছে, নড়ার কোনো চিহ্নই নেই। বামুনকে খিস্তি মারব বলে ঘুরতে যাচ্ছি ঠিক সেই সময় চোখের সামনে যা ঘটল তার বর্ণনা এখনো পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে রয়েছে। তালার থেকে আমার চোখ হয়ত পাঁচ ফুট হবে মেরেকেটে, অত কাছ থেকে ভুল দেখা সম্ভব নয়। তালাটা যেন হঠাৎ কোনো জাদুমন্ত্রে প্রাণ ফিরে পেল। প্রথমে একটু নড়ে উঠলো, তারপর তলার হুকের দিকটা কড়ার মধ্যে থাকলেও তাকে কেন্দ্র করে তালার মেন বডিটা ঘুরে উপরের দিকে উঠতে লাগলো – প্রথমে আসতে আসতে, তারপর বেশ তাড়াতাড়িই। তালা যখন থামল তার যাত্রা শেষ করে, চাবির দিকটা আমার চোখের সামনে। চাক্ষুষ একটা তালা ঘুরে নিচের দিকটা উপরে হয়ে দাঁড়িয়ে, নিউটন সাহেবের মাধ্যাকর্ষণ নস্যাৎ করে। 
আমাদের জীবনে এরকম অনেক মুহূর্ত আসে যেগুলো কখনো চেষ্টা করেও ভোলা যায়না। ৯৭য়ের সেই রাত্রির সেই মুহুর্তটাও সেরকমই এক ক্ষণ যখন নিজের অস্তিত্বকে মনে হয় অবান্তর, মনে হয় এতদিন যা শিখে, জেনে, বিশ্বাস করে এসেছি এক লহমায় তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তাত্ত্বিক যৌক্তিক সত্ত্বাটাকে জলাঞ্জলি দিয়ে মনে ঢুকে আসে ভয়। ঠিক সেই সময়টাতে ভয়কে যেমন ভাবে প্রত্যক্ষ করেছি, সেরকম জীবনে এখনো অবধি আর কখনো হয়নি। ভয় এসে যেন সারা শরীরটাকে বিকল করে দিয়ে গেল। রূপকথার জাদুর ছোঁয়ায় বা মেডুসার চোখের চাহনিতে মানুষ যেমন পাথর হয়ে যায়, সেরকমই যেন পা দুটোকে কেউ ফেভিকল দিয়ে মেঝেতে এঁটে দিয়ে গেছে। সম্মোহিতের মত তাকিয়ে রইলাম ছায়া আবছায়া ঘেরা টিমটিমে আলো পড়া তালাটার দিকে, যেন সেটার ওপরই নির্ভর করছে আমাদের ভাগ্য, তালা খুলে গেলে দরজার ওপারের প্রেত জগৎ গ্রাস করে নেবে আমাদের।
– হনু পালা। ওই ঘরে ভূত আছে। 
সম্বিত ফিরে এলো তথার গলায়। ও কথা শেষ করার আগেই আমি আদ্ধেক রাস্তা পেরিয়ে এসেছি। ব্যাটগুলো ছুঁড়ে ফেললাম বোর্ডের ওপর কিন্তু কড়া নিয়ম সব আলো নিভিয়ে কমন রুমের দরজা লক করে তবেই যাওয়া যাবে। কতক্ষণ লেগেছিল সেগুলো সারতে মনে নেই, খালি মনে হচ্ছিল প্রতিটা সেকেন্ড দেরী করছি তালা লাগাতে, ওপারের থেকে আমাদের দুরত্বটাও কমে আসছে বেশ খানিকটা করে। কমন রুমের বাইরে আলো একটু রয়েছে সিঁড়ির কাছে সেখানে সব ছাত্রদের সাইকেল রাখা। দৌড়তে গিয়ে দুমদাম পড়ল দু চারটে সাইকেল, তখন আমাদের দাঁড়িয়ে সেগুলো খাড়া করার সময় নেই। সিঁড়ি থেকে অন্ধকার করিডোর দিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে ঘরে ফিরে দরজাটাকে যত ভাবে সম্ভব এঁটে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছু শুনতে পাওয়া যায় কিনা দেখতে। বুক তখন ধড়ফড় করছে, ওপারের জগতের থেকে কয়েক গজ দুরে ছিলাম সেটা ভেবেই হাড় হিম হয়ে রয়েছে তখন, চোখের সামনে রিপ্লে দেখতে পাচ্ছি তালাটার চলাফেরা। তবু মন জানতে চাইছে ঠিক কি ছিল দরজার পেছনে। নিউজ রুমে কি কেউ কখনো আত্মহত্যা করেছিল? নাকি এরা চা বাগান আর করলার দিকে ধানক্ষেতে গুমখুন হওয়া আত্মা, চাঁদনি রাতে চা বাগানে ভেসে বেড়ানো প্রেতকুল? রুমে ফিরে আমি আর তথা অনেক বিচার করে দেখলাম যে আমাদের বিভ্রান্তি বিন্দুমাত্রও কাটেনি বরং বেড়েছে। তবে আর একটা ব্যাপারও মনে হলো তখন। পরদিন লোকজনকে বললে যে তারা আমাদের প্রচুর খোরাক দেবে তা তখনি পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল, আমাদের রক্ত জল করা অভিজ্ঞতা যে আর কেউ বিশ্বাস করবে তা একবারের জন্যও মনে হয়নি। সে হোক বা, আমরা এটুকুই ভাবতে পারছিলাম তখন যে আমরা দুজনেই একটা ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি যার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা আমাদের নেই। কি ছিল সেটা জানতে না পারলেও এই ঘটনাটা মনের মধ্যে গেঁথে গেল চিরদিনের জন্যে। তালা ভুতের সেই ঘটনা আমার জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর মধ্যে একটা। চোখ বুজলে এখনও দেখতে পাই সেই আবছায়া ঘেরা কমন রুম, চেয়ার থাম এসবের ছায়ায় ঘেরা নিউজ রুমের দরজা, শুনশান রাতের নিস্তব্ধতা আর এসবের মাঝে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা তালা – অধিভৌতিকের চরম অভিজ্ঞতা। মন তবু প্রশ্ন করে সেই রাত্রে ওই দরজার পেছনে কি ছিল? খেদ রয়েই গেল যে সেটা জানতে পারলাম না। যদি পারতাম তবে কি আজ আমি থাকতাম? কে জানে।
পরিশেষ: কি ছিল দরজার পেছনে সেই রহস্যের যবনিকা উঠলো পরদিন। যেমনটা আশা করেছিলাম ঠিক তাই। যতজনকে বললাম আমাদের অভিজ্ঞতার কথা সবাই অনেক ঠাট্টা করলো। এসব নাকি ছিল আমাদের কল্পনা আর গোঁড়া কুসংস্কার। দুপুরের দিকে একদল ফার্স্ট ইয়ার আমাদের টানতে টানতে নিয়ে গেল কমন রুমে। উদ্দেশ্য প্রমান করা যে আমরা ভুল দেখেছি। আমাদের যাবার কোনো প্রবৃত্তি ছিলনা তাই পেছনে দাঁড়িয়ে রইলাম, বাকিরা প্রবল উৎসাহে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জরিপ করতে লাগলো চারদিক। হঠাৎ সেই ভরদুপুরে আমাদের দু জোড়া নয় একগাদা চোখের সামনে তালা আবার ওপরের দিকে ঘোরা আরম্ভ করলো। অতিউৎসাহীর দলের সেই উচ্ছ্বাস নিমেষে মিলিয়ে গেল, সবাই যে যার মত দরজার দিকে দৌড়তে আরম্ভ করলো। দাঁড়িয়ে ছিল যতদুর মনে পড়ে বিক্রম আর ডিফেন্স। ওরা খানিক পিছু হঠে আবার গেল দরজার সামনে, আর তখনি বোঝা গেল আসল কারণ। ওরা দেখল যে নিউজ রুমের দরজাটা নড়ছে, আর যতবার দরজা পেছনের দিকে সরছে তালাটা ওপরের দিকে ওঠার চেচ্টা করছে ঠেলা মেরে। এতক্ষণে বোঝা গেল দায়ী টা কে। সেটা ছিল ডুয়ার্স থেকে ভেসে আসা বাতাস – নিউজ রুমের খড়খড়ি পেরিয়ে ওই হাওয়া ঠেলা মারছিল দরজায় আর দরজার কড়া তালাকে ঠেলছিল খাড়া হবার চেষ্টায়। রহস্য সমাধান হয়ে গেল, অতি সাহসীরা আবার ফিরে এলো, পিঠ চাপড়ানো হলো সবার, আমি আর তথা হয়ে গেলাম আবার খোরাকের টার্গেট যেহেতু আমরা দুয়ে দুয়ে চার করতে পারিনি। সত্যি আর কল্পনার জগতের তফাতটা রাতের দিকে অনেক বেশি অস্পষ্ট, দিনের বেলা যা পরিষ্কার ভাবে দেখা যায়, রাতের বেলা আলো আঁধারীতে তাকেই মনে হয় ভৌতিক। মনে কিন্তু খটকাটা রয়েই গেল। সেই রাত্তিরে ওই দরজার পেছনে সত্যিই কি কেউ ছিল?  উত্তরটা মনে হয় লুকিয়ে আছে আমাদের মনের ভেতর। কেউ ছিল সে রাত্রে যদি আমরা মনে করি কেউ ছিল।  যদি মনে করি ছিলনা, তাহলে সেটা শুধু হাওয়ার খেলা।

Saturday 7 November 2015

The curious incident of the phantom lock

It was the spring of 1997, and I was in my first year studying degree in engineering in a quaint town of Jalpaiguri in north Bengal. The campus was a nature lover's paradise — the north and west peripheries abutted the verdant Danguajhar tea garden, two silvery rivers meandering along east and west boundaries. In spring, the soft breeze blew from the north — down from the Dooars, the hinterland of the eastern Himalayas. Nothing could provide more thrilling backdrop to the spine-chilling, bloodcurdling experience that I witnessed on that spring night, which I'm going to unfurl. 

On the northern side of our first year hostel, there was a common recreation room, with a TV, a number of carom boards and the latest addition — a new table tennis board. At the far corner, a door led to a small ante room, filled with a long table and narrow benches, and large slatted windows opening up to the lush greens of the tea gardens. We used to refer it as News room, and it only opened at daytime between midday and 4 pm. At lunchtime, keen students would spend the lunch break in this room, soaking up the news around the world, to sharpen their general knowledge, whilst the other despotic ones would turn the TV on, or try a game of carom or some table tennis. 

That year, table tennis was particularly favourite as the hostel received a sports funding and the boarders saw the swank new table tennis board, and a number of thick rubber padded new bats. We shared the hostel with third year students, and there was an unwritten rule that they get to play first, unless some senior took pity on the eagerly waiting hapless fresher, looking dejected from the long wait. The first years started to flock around the tables after dinner, as the seniors began to go back to their rooms for coursework or bridge sessions. My roommate Tatha and I were very keen to find some time to hone our paddling skills, yet the wait seemed to be endless. 

Our story begins on one such weekday evening, when we had enough and decided to stay back as long as it took to play more than just one game. Our perseverance finally paid off, when around 11:30pm the crowd started to disperse. Lights over carom boards went out first, boards covered with dark blue jackets, then a while later TV was turned off as the last few of the TV addicts got up to get ready for bed. Just a few more of our classmates hovered around, and taking turns after each game, we were not too disappointed. The last two or three went to bed about half past midnight, leaving us the empty common room, a dimly lit incandescent lamp just over the table tennis board — barely struggling to illuminate past the rickety steel chairs behind us. 

Tic…toc…tic…toc…tic…toc…our ears gradually got bored to the incessant din of the ping pong ball on the bat. Arms got heavier, yet high on spirit, we carried on, mastering the spinning serves or backhand smashes, and the hands of the clock on the wall nonchalantly kept telling us the time 1:00 to 1:30 to 2:00. As I stood facing the door, tired of the ball going outside the common room, Tatha shut the door and we carried on playing with same élan. We were extremely tired, yet we continued like zombies, as if we were being controlled by some remote psychomotor commands and our only aim was to keep on playing. 

That state of active ennui broke when Tatha paused for a moment before serving and looked past me, and stood still. "What's going on? Why aren't you serving?", I asked. Tatha paused for a moment then said, "I thought I saw something flash around that door". He was pointing at the door to the news room. Then he said it must be the light catching something. We carried on playing and soon forgot about it. Another half hour passed, and we decided to call it a day after best of three sets. 

It was halfway through our game, when Tatha smashed a winner and the ball rolled on towards the back end of the room. Just as I picked the ball up and was coming back to the table, I looked at Tatha and saw his startled face, and the frowned eyes looking behind me. By nature, I can imagine things quite easily and be scared, nevertheless  usually I still can keep my logical hat on — only real things make me afraid. Looking Tatha in such a state sent a gush of adrenalin through my blood, and my body became instantly alert to witness something out of the ordinary. My heart racing, I asked Tatha again
— what's the matter with you now?
— I saw the lock move. 
— what nonsense. You must have seen the light reflecting on the lock. 
At this point, I have gained my composure back. I reasoned my thoughts, that we have been playing for a long time, with the main door to the common room shut, so no one could have come in. I looked back at the news room door and the new lock on the hasp and staple bolts. Although the dimly lit room, barely managing to illuminate the dark corners, created an eerie sight, I decided to overcome my initial fear and walked up to the door. The lock remained as it was — lifeless lump of metal, hanging from the latch as expected. Its stainless steel body throwing back some of the paltry light coming from the lamp over the table tennis board. I shouted back at Tatha "see there's nothing here, the lock did not move! Let's just have this game and get back to the room". Tatha looked reassured as well. So I started walking towards the board trying to reconvene where we left the game.

Suddenly my composure was shattered by a rather uncharacteristic raspy shout by Tatha
— HONU, I swear it just moved again! 
With a déjà vu moment, my composure disappeared again, and I started to doubt my logical self, thinking something sinister was about to happen. Goosebumps shot up all over my fatigued and sweaty body, yet I tried to run through all plausible explanations why Tatha saw the lock move. 
— what do you mean? It's not the time for a prank you know! 
— I swear it MOVED! Oh look, IT NOVED AGAIN!!! Come away Honu, something spooky behind that door it's trying to come out!
Spooky and I don't get along very well, yet out of indomitable urge to know what's going on, rather than running away, I took a few steps back towards the news room door, curiously watching the lock. Time must have stood still at that moment, as I saw the lock still lying limp on the door latch…and then it happened! I stood a metre away from the door, and right in front of my eyes, the lock started to move! Not just an odd shake, the lock started to turn upwards. The shackle of the lock still fastened through the staple part of the latch, the lock turned up — first gradually moving only millimetres, then much faster — and then it stopped with the keyhole facing me.

There are moments in my life, which I will never forget, and can reminisce any time without a chance of that memory's fading away, and that moment was the most scared I've ever felt. These are the moments, where logic bids adieu scratching its head as it had no explanation, leaving the witness in a state on utter shock and fear. Fear. That's is all I could feel engulfing me rapidly, the molten fear running through my veins, my heart trying to burst apart in anticipation of what's happening next. My limbs felt all numb, even if I knew my mind is telling me to run, my legs felt as if they were filled with lead. Transfixed at the gravity defying position of the lock, at that moment of time, it seemed that the lock is trying to send some message to the animate world from the supernatural, and it was the last bastion that's protecting the barrier that was the news room door between the dead and the undead. 

The adrenaline in my blood must have made my perceptions of time extremely prolonged, as all that feeling and moments of mesmerised gaze on the lock didn't last more than five seconds, when I got my senses back by Tatha's scream
— Honu, come away from that door! It's haunted. RUN NOW!!!
That shout broke me free of the spell that phenomenon I just witnessed cast over me. Before Tatha could finish his sentence, I was running off, throwing the table tennis bats on the board. We had to turn all the light off, despite fearing the darkness will swallow us, and had to lock the common room door — fumbling with the keys with shaking hands.  Outside, we were met with dimly lit foyer, strewn with the boarders' bicycles. We ran to our room, throwing a few cycles along the way, along the dark corridor, still fearing something through the darkness would just grab my ankles. Entering our room, we bolted the door in all possible combinations and pressed our ears against the door, if they could pick up any faint movement in the corridor. Our encounter with the other side left us completely sapped of energy, courage or reason. My heart pounding incessantly, I kept running the events that unfolded right in front of my eyes over and over, yet found no explanation to the moment of paralysing fear I just experienced. May be it was some lost soul trying to find its way back to the living world, may be there was something terrible happened in the News room ages ago? May be it was those spirits of murdered people in the tea garden or the paddy fields, who glide over the eerie tea gardens on moonlit nights. We will never know who or what it was, but that incident on that Spring night has permanently been etched in my mind, although I rather wish it never happened to me. At that very moment Tatha and I both stood dumbfounded, without any answer. All we knew is, that the next day when we tell our story, we will become a laughing stock, no one will believe the bloodcurdling experience. Yet, we will always remember those few seconds that put ur existence in question — our encounter with the other side. The incident of "phantom lock" would become one of the most memorable yet frightening moments of my life, as well as the biggest mysteries, because I will never fathom out, who or what it was that lifted the lock in the air and held it up for all the duration we were there. Reminiscing of the dimly lit common room, the tic-tocs of the table tennis, the inexplicable mosaics formed by the light and shadow from the lamp and amid that background, a moving lock — it always made me wonder, what was there behind that dark News room door that night? I wish I knew. I only wish. Or rather not…

PS: In fact it was discovered what it was the next morning. As predicted, our story was met with ridicule and disdain. At lunchtime finally a troupe of classmates went to the door, to prove that it was only a figment of our imagination and boorish superstition. And yet again, in broad daylight, the lock began to move…slowly rising up before everyone could see the keyhole right in front of their eyes. The hysteria that followed was deafening. Most of the disbeliever band was dispersed, running as fast as they can. But some brave ones stepped back and then went back to the door again. It was just then the mystery unveiled, as they noticed the door was moving. It was that Spring dooars breeze gushing inside the News room through the slatted windows and pushing the door. The hasp of the latch was moving, pressing the lock to move with it. The mystery was solved, backs patted, the salvo of derision against us was quadrupled that we didn't figure out this simple causality. Yet I will remember that night as it happened, when the lights and shadows played games with our mind, and the lack of daylight smudged the defined line between the worlds of reality and fantasy. May be there was something else behind that door that night, but we will never know. There probably was if you believe there was, or nothing if you don't believe…

PPS: On that night, after coming back in our room, we realised that we needed to go to the toilet, yet could not walk along the empty and dark corridor again to, nor open the grilled window to do it. So we used Rahul Singh's bucket we borrowed the previous day for shower. If Rahul ever reads this, this is an unreserved apology for peeing in your bucket without permission, under unavoidable circumstances. 

Monday 19 October 2015

তেইদে উপত্যকায় একদিন

অতলান্তিক মহাসাগরের বুকে আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর পশ্চিম কোণে সাতটি দ্বীপ। স্পেনের অধীনে তাই স্পেনীয় ভাষায় এদের নাম Islas Canarias বা ক্যানারী দ্বীপপুঞ্জ। তার মাঝে সবচেয়ে বড় দ্বীপ হলো Tenerife। স্পেনীয়রা উচ্চারণ করে তেনেরিফে, ইংরেজরা বলে টেনেরিফ, খটখটে জার্মানরা আরো এককাঠি ওপরে গিয়ে বলে টেনেরিফফা। আকার প্রকারে বিশেষ বড় না হলেও পশ্চিম জগতে তেনেরিফে বেশ চেনা নাম। প্রতি বছর ঝাঁকে ঝাঁকে ইংরেজ ফরাসী জার্মান পর্যটকরা ভিড় করে ক্যানারী দ্বীপপুঞ্জে বিষুবরেখার কাছাকাছি সূর্যের পুরো তেজ উপভোগ করার জন্যে। তার ওপর আছে অতলান্তিক মহাসাগরের সুনীল উচ্ছ্বল জলরাশির হাতছানি। সেসব বিবেচনা করে সোফিয়ার প্রথম বিমানযাত্রার গন্তব্য হিসেবে ঠিক করলাম অক্টোবরের তেনেরিফে, যাতে গ্রীষ্মকালের আগুনে তাপের বদলে শরতের উষ্ণ আবহাওয়ায় ছুটিটা উপভোগ করা যায়। সাতদিনের সেই অবিস্মরনীয় অভিজ্ঞতার পুরো বর্ণনা দেয়া অসাধ্য, তাই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিনটার কথাই বিশদভাবে লিখলাম এখানে, তবে সেই সাথে রইল তেনেরিফের একটা সংক্ষিপ্ত ছবি।

তেনেরিফে দ্বীপটার আকার অনেকটা কাঁচা হাতের বানানো প্রথম পরোটার মত - এমনিতে তিনকোনা, উত্তর দিকটা যেন ত্রিভুজের একটা বাহু তারপর পূর্ব আর পশ্চিম দিকের দুটো বাহু দক্ষিনে গিয়ে মিশেছে। আর উত্তর পূর্ব দিকটা যেন খানিকটা টেনে লম্বা করা। ক্যানারী দ্বীপপুঞ্জ হলো অতলান্তিক মহাসাগরের বুক ফুঁড়ে ওঠা কিছু আগ্নেয় পর্বতের সমষ্টি, বহু বছর ধরে উদ্গীরণের লাভা জমে জমে দ্বীপগুলোর সৃষ্টি। তেনেরিফের অন্যতম বৈশিষ্ট সেরকমই এক আগ্নেয় পর্বত Pico de Teide বা তেইদে পর্বতশৃঙ্গ। শেষ অগ্ন্যুৎপাত হয় ১৯০৯ সালে, সেই তেইদে পর্বকেই বলা যেতে পারে তেনেরিফের মূল কেন্দ্র। তেইদে থেকে শুরু করে গোটা দ্বীপটার চারদিকে আগ্নেয় পাথরের পর্বতমালা, যার উচ্চতা তেইদের আশেপাশে ২৫০০মি থেকে কমতে কমতে একদম তটরেখার কাছে হঠাৎ ঢালু হয়ে সমুদ্রে মিশেছে। একেবারে দক্ষিনে যেখানে ত্রিভুজের দুই বহু মিলেছে সেখানে খানিকটা সমভূমি, বাকি যে কোনো দিকে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের উল্টোদিকে চাইলেই দেখা যাবে পাহাড় শুরু হয়ে গেছে আর সবার মাথা ছাড়িয়ে সুদূরে অবস্থান করছে সেই তেইদে যা স্পেনের সর্বোচ্চ পর্বতশিখর। দক্ষিন আর পূর্বদিকের পাহাড়গুলো ঊষর আগ্নেয় পাথরে তৈরী তবে পশ্চিম আর উত্তরে তাকালে দেখা যাবে সবুজ পাহাড়ের রাশি। সেই সব পাহাড়ের রাশি আর সমুদ্র তার মিশ্রনে তৈরী হয়েছে প্রকৃতির এক অননুকরণীয় ভূমিরূপ। বিচ মানেই যে সোনালী বালুকাবেলার ধারণা করি আমরা তেনেরিফের তট তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। আগ্নেয় পাথরের আর লাভার সংমিশ্রনে সেই বালির রং ঘোর কালো। সেই কালো সমুদ্রতটে যখন আছড়ে পরে উদ্দাম অতলান্তিক মহাসাগরের ঢেউ, আর দুরে চাইলে সমুদ্র আর আকাশের নীল যে কোথায় মিশেছে তা ঠাহর করা যায়না, তখন মনে হয় প্রকৃতি তার নিজের খেয়ালে এই পৃথিবীকে কি অপুর্বভাবেই না সাজিয়েছে।
পুয়ের্তো দে লা ক্রুজ সমুদ্রতট 
তেনেরিফেতে যে শহরে আমরা ছিলাম তার নাম পুয়ের্তো দে লা ক্রুজ, উত্তর দিকে এক বড় শহর। উল্লেখ্য যে এই দ্বীপের বেশির ভাগটাই পাথুরে পর্বত বলে তেনেরিফের সব বড় শহরগুলোই একদম সমুদ্রের ধারে। পুয়ের্তো দে লা ক্রুজ থেকে হাইওয়ে পশ্চিমে চলে গেছে ইকদ দে লস বিনোস হয়ে গারাচিকোর  দিকে যেখানে সমুদ্রে সারি সারি ডলফিন খেলা করে, অনেকে যায় সমুদ্রে শুধু ডলফিন দেখতেই। অন্য দিকে হাইওয়ে প্রথমে পূর্বে তারপর দক্ষিনে বাঁক নিয়ে তেনেরিফের প্রধান শহর সান্তা ক্রুজ দে তেনেরিফে ছুঁয়ে চলে গিয়েছে দক্ষিনে এয়ারপোর্টের দিকে লস ক্রিস্তিয়ানোস, আদেখে অবধি। দ্বীপের এই উত্তর দক্ষিন বিভাগের সাথে জুড়ে আছে মানুষের বেড়ানোর পছন্দ অপছন্দ। দক্ষিন দিকটা খুব বানিজ্যিক, হোটেল বাড়িঘর সব চোখধাঁধানো, খাবারের রেস্তোঁরার রকম অগুন্তি। এদিকে বিশেষ করে আসে ইংরেজরা মার্কিনরা তাদের দেশের বাইরে দেশের সুযোগ সুবিধা স্বাচ্ছন্দ্য বেশি প্রিয়। অন্যদিকে উত্তর দিকে গেলে সবই স্পেনীয়। খাবারের জায়গাগুলো মূলত স্পেনীয় খাবারই বিক্রি করে আর বাড়িঘর সাধারণ। স্পেন দেশে গিয়ে সেখানকার মানুষদের আদব কায়দা রীতি নীতি শিল্প ভাস্কর্য দেখতে হলে উত্তরই শ্রেষ্ঠ। এদিকের বেশীরভাগ থাকতে আসা লোকই জার্মান। উত্তর বেশ প্রাকৃতিক, দক্ষিন সে তুলনায় বেশ কৃত্রিম। তেনেরিফের পূর্ব দিক জুড়ে ছড়িয়ে আছে অনেক ছোট ছোট শহর।  পশ্চিম দিকটা সেই তুলনায় অনেকটা দুর্গমই বলা চলে, তবে সেদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও সেই তুলনায় অপূর্ব।
পুয়ের্তো দে লা ক্রুজ
যে দিনটা নিয়ে লেখার অবতারণা সেই দিনের কথায় যাওয়া যাক। তেনেরিফের উত্তর দক্ষিন সব দিকের রিসর্টগুলো থেকেই তেইদে পর্বতের একটা আদ্ধেক দিনের ট্যুর করা হয়।  তেইদের মূল আকর্ষণ হলো পর্বতের বেস ক্যাম্প থেকে রোপওয়ে যেটা প্রায় হাজার মিটার উঠে তেইদের প্রায় চূড়ায় পৌঁছে দেয়। তবে সেই ওপরের স্টেশন থেকে তেইদের চূড়া আরো ২৫০মি আর সেখানে উঠতে গেলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগে, তাই সাধারণ ট্যুরিস্টরা রোপওয়ের শেষে গিয়ে খানিক ঘুরেই ফিরে আসে। ট্যুর গুলো সাধারণত বাসে করে নিয়ে যায়, তাদের তাড়া থাকে আদ্ধেক দিনে সবাইকে ফিরিয়ে আনার, তাই বেশিক্ষণ কাটানো যায়না। সেই সব  বিবেচনা করে আগেই ঠিক করেছিলাম গাড়ি ভাড়া করেই যাব। যে গাড়ি ভাড়া পাওয়া গেল সে তো এক টিনের কৌটো বলা যেতে পারে, তাও একদিন আগে ভাড়া নিয়েছিলাম বলে রক্ষে পাহাড়ি রাস্তায় যাবার আগে বাঁহাতি গাড়ি চালানোর প্রথম অভিজ্ঞতা নাহলে তেমন উপভোগ্য হতোনা। এক দিন চালিয়েও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি ব্যাক গিয়ারটা ঠিক কিভাবে কাজ করে। যাহোক সকালের দিকে কাতারে কাতারে বাস ভিড় করে তেইদেতে তাই যেতে হবে খুব সকালে বা দুপুরের দিকে। ধীরেসুস্থে দুপুরে যাওয়াটাই ঠিক করলাম কারণ সকালের দিকে কুয়াশায় পর্বতের ওপর থেকে কতটা দেখা যাবে সেই ভেবে। ১১টা নাগাদ যাত্রা শুরু হলো পুয়ের্তো দে লা ক্রুজকে পেছনে ফেলে। শহরে যাবার মূল রাস্তা যেখানে হাইওয়েতে মিশেছে সেখানে ডানদিকে মোড় নিয়ে শুরু হলো চড়াই ভাঙা। হাইওয়ে ছেড়েই প্রথম রাস্তায় পড়বে লা ওরোতাবা (La Orotava) বলে একটা ছোট আর সুন্দর শহর। লা ওরোতাবায় নাকি তেনেরিফের যত নামজাদা লোকজন তাদের বাড়িঘর ছিল আঠার উনিশ শতকে।শহরের মেন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতেই মনে হছিল রাস্তার চড়াই বেশ খাড়া। ওরোতাবাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চললাম পিকো দে তেইদের দিক নির্দেশ করা রাস্তা ধরে। রাস্তার দুপাশে টিপিক্যাল স্পেনীয় বাড়িঘর, এক এক বাড়ির এক এক রকম আকার আর রঙ, পশ্চিম ইউরোপের মত একঘেয়ে লাল টালির নয়।  বাড়ি দোকান এসবের পেছনে ঘন গাছগাছালি তারপর পাহাড় উঠে গেছে ওপরের দিকে। অন্য দিকে ঢালের দিকে তাকালে নিচে ওরোতাবা আর আরো দুরে পুয়ের্তো দে লা ক্রুজের সীমানা ছাড়িয়ে দিগন্তরেখা অবধি সুনীল অতলান্তিক। খানিক রাস্তা হারিয়ে তারপর ফের আসল রাস্তা খুঁজে পেয়ে এগিয়ে চলল গাড়ি একে একে ছোটো ছোটো জায়গা পেরিয়ে। আসিয়েন্দা পের্দিদা, সিয়েরা ইত্যাদি ছাড়িয়ে প্রথম স্টপ চাসনা বলে একটা জায়গায় শুধু দেখে নেয়া নিচে ফেলে আসা ওরোতাবা উপত্যকা। এখানেই ঘটল অঘটনটা। জেনিফার গোটাকয় ছবি তুলে ফিরেছে, সোফিয়া ঘুমোচ্ছে, ঢালে গাড়ি ব্যাক করতে গিয়ে দেখি গিয়ার কাজ করছেনা, আর যতবার চালু করার চেষ্টা করছি গাড়ি ততবারই খানিটা করে গড়িয়ে সামনের পাথরের দেয়ালের দিকে এগিয়ে চলেছে। যখন ইঞ্চি দুই দুরে, কপালজোরে ব্যাক গিয়ারটা লেগে গেল, আমরা আবার ১০মিনিট ঘাম ঝরিয়ে এগিয়ে চললাম আগুয়ামানসা বলে একটা জায়গার দিকে। একে একে দেখছি উচ্চতা পাল্টাতে আরম্ভ করেছে রাস্তার ধারের মার্কারগুলোয়। আগুয়ামানসা প্রায় ১৩০০ মিটার উঁচুতে সমুদ্র থেকে। আগুয়ামানসার পর রাস্তার দুপাশের দৃশ্য বদলে গেল।  ঘরবাড়ি আর নেই এবার দুদিকেই ঘন চিরহরিৎ গাছের জঙ্গল। পাহাড়ি গাছগাছড়ার সাথে তেমন পরিচিতি নেই তাই পাইন আর রোডোডেনড্রন এদুটোই শুধু চেনা গেল। খানিক পর পরই এই জঙ্গলে ঘেরা রাস্তার মাঝে ভিউয়িং পয়েন্ট যাতে লোকজন থেমে সামনের দৃশ্য দেখার জন্য থামতে পারে। এখান থেকে উত্তরের দৃশ্য অসামান্য। নিচে তাকালে ঘন গাছের মাথা ছাড়িয়ে পুয়ের্তো দে লা ক্রুজ তখন পিং পং বলের মত ছোট।  বাকি চারদিকে নীল আর নীল। কোথায় আকাশ আর কোথায় সমুদ্র তা হলফ করা দুঃসাধ্য, খালি সমুদ্রটা একটু যেন বেশি গাঢ় নীল। অন্যদিকে কুয়াশা ঢাকা পর্বত উঠে গেছে ওপরের দিকে, আর দুরে আবছা দেখা যাচ্ছে তেইদের সীমারেখা। নিচে পুয়ের্তো দে লা ক্রুজে ঝলমলে দিন হলেও এখানে ওপরের দিকে বেশ কুয়াশা, মনটা খানিকটা মুষড়ে গেল কুয়াশা কাটবে কিনা সেই চিন্তায়। রওনা দিয়ে ঠিক করলাম বেলা হয়ে যাচ্ছে আর থামবনা কোথাও তেইদের আগে। জঙ্গল যে কে সেই দুদিকে ছেয়ে আর দেখছি উচ্চতা একটু একটু করে বেড়েই চলেছে ১৫০০..১৬০০..১৭০০মি। 
পাইন অরণ্য তেইদের পথে 
প্রায় ১৮০০ মিটারে এসে একটা বাঁক নিয়েছি হঠাৎ চারপাশটা যেন আবার হুশ করে বদলে গেল। গাছপালা জঙ্গল নিমেষে উধাও, শুরু হয়ে গেছে পাথুরে পর্বতরাশি। আগ্নেয় পাথরের সেই ভূমিরূপে বিচিত্র সব রঙ হলুদ থেকে কমলা আর বাদামী থেকে কালোর কতরকমের যে সংমিশ্রণ হওয়া সম্ভব, সেই পাথুরে এলাকা না দেখলে বিশ্বাস হতনা। আর খানিকটা উঠে চোখে পড়ল বিরাট বড় সাইন পার্কে নাসিওনাল দেল তেইদে (Parque nacional  del Teide)।  এখান থেকেই শুরু তেইদের চড়াই। আমরা তখন প্রায় ১৯০০মি উঁচুতে, আকাশ ঝকঝকে নীল, কোনো মেঘের চিহ্নমাত্র নেই, কুয়াশা ফেলে এসেছি নিচে। প্রায় ২০০০মি উঁচুতে উপস্থিত হলাম এক আশ্চর্য জায়গায় যার নাম মিনাস দে সান হোসে (Minas de San José) বাংলায় অনুবাদ করলে সান হোসে খনি। রাস্তার দুপাশে গাড়ি দাঁড় করানোর জায়গা। এ জায়গা আগে ছিল ঝামা পাথরের খোলা খনি। এখানে পায়ের নিচে জমি কমলা বাদামী মেশানো রঙের ঝামা পাথরের কাঁকর। হাজার হাজার বছর ধরে আগ্নেয়গিরির লাভা, সূর্যের তেজ, দিন-রাতের তাপমাত্রার ওঠানামা আর তেজি হাওয়া এই সবে মিলে তৈরী করেছে সেই অসাধারণ ছবির মত ল্যান্ডস্কেপ। সেই কাঁকরে ঢাকা ঢেউ খেলানো জমি রাস্তার ডানদিকে উঠে গেছে তেইদেকে ঘিরে থাকা পর্বত গুলোর দিকে। এদিকে তাকালে কাঁকরে ঢাকা জমিতে মাঝে মধ্যে চাগিয়ে উঠেছে ছোট বড় পাথরের স্তুপ। আর তার পেছনে অনন্য গরিমায় দাঁড়িয়ে আছে তেইদে পর্বত, ২২০০মি উচ্চতা থেকে দেখলেও মনে হবে পর্বতের মাথা যেন আকাশকে ছুঁয়ে আছে। অন্যদিকে রাস্তার উল্টোপাড়ে সেই কাঁকুরে জমি অল্প ঢালে নেমে গিয়েছে নিচের দিকে। সেদিকে খানিক দূর গিয়ে বড় বড় পাথরের চাঁইগুলোর ভেতর দিয়ে নিচের দিকে তাকালে সে দৃশ্যাবলী মনের মধ্যে চিরদিনের জন্যে গেঁথে থাকবে। পাথরের স্তুপের পর জমি খাড়া নেমে গিয়েছে কয়েকশ মিটার কিন্তু তারপর সমতল জমি বিস্তৃত প্রায় কয়েক মাইল, তার শেষে পর্বতরাজি উঠে গেছে কয়েকশ মিটার। তেইদের চারদিকে সমতলভূমি পেরিয়ে এই পর্বতগুলো নির্দেশ করছে পার্কে নাসিওনাল দেল তেইদের সীমানা, যার উল্টোদিকে ঢাল নেমে গেছে ফেলে আসা পাইন অরণ্যের দিকে। বেশি দেরী হয়ে যাবার চিন্তায় হাতের আর মনের ক্যামেরায় ঊষর সেই তেইদে উপত্যকার ছবি সঞ্চয় করে এগিয়ে চললাম মূল আকর্ষণের দিকে, তেইদে পর্বত আর কেবল কার যার পোষাকী নাম তেলেফেরিকো দেল তেইদে। মূল রাস্তার থেকে ডানদিকে মোড় ঘুরে রাস্তা খাড়াই উঠে গেছে তেইদের এই বেস ক্যাম্পে।
মিনাস দে সান হোসে 
তেইদে উপত্যকা 
 তেইদের রোপওয়ের সেই নিচের প্রান্তে তখনো গাড়ির ছড়াছড়ি। মেন কারপার্ক ছাড়াও চড়াই রাস্তার আশেপাশে পাথরের ওপর অনেক পার্কিংয়ের জায়গা, সব ভর্তি। ভাগ্যক্রমে একটা জায়গা খুঁজে পেয়ে গাড়িটা রেখে রওনা দিলাম টিকিট কাউন্টারের দিকে। গিয়ে দেখি রোপওয়ের কর্মচারী বলছে সোফিয়ার ওপরে যাওয়াটা নিরাপদ নয়। রোপওয়ের অপরের প্রান্ত ৩৫৪০মি উঁচুতে, সেখানে অক্সিজেন তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের তেমন অসুবিধা না হলেও ছোট বাচ্চাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হতে পারে। এই সব ভেবে জেনিফার রয়ে গেল সোফিয়ার সাথে নিচে, আমি টিকেট কেটে দাঁড়িয়ে পড়লাম রোপওয়ের লাইনে। কেবল কারের এই জায়গাটা থেকে তেইদের শিখর দেখা যায়না। সামনের ঢালটা এত খাড়া যে চূড়াটা তার পেছনে ঢাকা পড়ে আছে। রোপওয়ে বলতে এলাহী ব্যাপার। বিরাট বড় বড় টাওয়ার তার দুদিকে দুটো কেবল লাইন, একটা কার যখন নিচে, অন্যটা তখন ওপরে, দুটো একসাথে যাত্রা শুরু করে সব সময়, ২৫০০মি থেকে ৩৫৪০মি এই পুরো দূরত্ব যেতে সময় লাগে মোটে ৮ মিনিট। লাইনে বাঙালির অভ্যেসমত ঠেলেঠুলে একদম সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম কেবল কারের কাঁচে ঘেরা বাক্সর সামনে জায়গা করে নেবার জন্য। একটু দোল খেয়ে কার যখন চড়া শুরু করলো তখন বেশ উত্তেজনা বোধ করছিলাম, ৫০মি নাগাদ যাবার পর যখন সেটা পুরো গতিতে চলতে শুরু করলো হঠাৎ খেয়াল হলো মাটি থেকে প্রায় ৫ তলা উঁচুতে রোপওয়ে চলছে, দড়ি ছিঁড়ে গেলে সাথে সাথে ভবলীলা সাঙ্গ । তার ওপর প্রতিটা টাওয়ার ক্রস করার পর ফিজিক্সের নিয়ম মেনে কেবল লাইনটা খানিকটা নিচে নেমে আসে আবার ওপরের দিকে যাবার আগে, সেই সময়টা মনে হয় যেন কারটা নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে। যাহোক, রাস্তার মাঝামাঝি সেই খাড়া চড়াই শেষ হলো, সামনে দাঁড়ানোর সুফল এতক্ষণে পাওয়া গেল, সামনে তেইদের শৃঙ্গ সমস্ত জানলা জুড়ে। ঠিক ৮ মিনিটের মাথায় কার থামল ওপর প্রান্তে। পুয়ের্তো দে লা ক্রুজ ছাড়ার সময় তাপমাত্রা ছিল ২৮, এই ৩৬০০মি উঁচুতে সেটা দাঁড়িয়েছে ৮ ডিগ্রী। বাইরে বেরিয়ে তেইদের দিকে তাকিয়ে মনটা উদাস হয়ে গেল। উত্তরবঙ্গে কলেজে থাকার সময় পাহাড়ে যেত বন্ধুরা কিন্তু আমার সেরকম পাহাড় চড়ার অভিজ্ঞতা হয়নি। এতদিন বাদে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি স্পেনের শীর্ষতম শৃঙ্গের প্রায় চূড়ায়, মাঝের পনের বছরে জীবন বদলে গিয়েছে বেশ। আর সেই মুহুর্তে এখানেও আমি একেবারে একা, এই অসাধারণ অভিজ্ঞতা কেবল আমার মনেই রয়ে যাবে, খানকয় ছবি থাকবে বটে কিন্তু সেই শিহরণ জাগানো মুহুর্তটা ভাগ করে নেয়া যাবেনা আর কারো সাথে। এসব ভেবে তাড়াতাড়ি আবার নিচে ফেরত যাব ঠিক করে খানিকটা দেখে নিলাম যতটা সম্ভব। রোপওয়ের ঘরের বাইরে পাথর কেটে তৈরী করা রাস্তা দুদিকে চলে গেছে দুটো ভিউয়িং পয়েন্টের দিকে। পশ্চিম দিকে গেলে দেখা যাবে আর একটা মৃত আগ্নেয়গিরি পিকো বিয়েখো (Pico Viejo), আর পূর্বদিকের পথের শেষে দেখা যাবে পুরো উত্তর দিকের ভূমিরূপ, কালো লাভা, মন্তে ব্লানকো পাইন অরণ্য ওরোতাবা উপত্যকা। আর এই দুই রাস্তার মাঝে ধাপে ধাপে কাটা পাথরের পায়ে হাঁটা পথ উঠে গেছে তেইদের শিখরে যেখান থেকে নাকি বাকি ছটা ক্যানারী দ্বীপপুঞ্জের দ্বীপই দেখা যায়। ট্র্যাভেল গাইড বলছে তেইদের চুড়ায় গেলে রাতটা সেখানেই কাটাতে তাহলে সকালে সূর্য ওঠার সময় এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা দেখা যায় যখন তেইদের তিনকোণা ছায়া ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে দুর থেকে দুরান্তে। এই ভরা দুপুরেও রোপওয়ের এই প্রান্ত থেকে সামনের দৃশ্যের বর্ণনা করা সাধ্যের বাইরে। উত্তর দিকে সমস্তটা জুড়ে তেইদে পর্বত পড়ন্ত রোদে ঝলমল করছে। নিচের দিকে খালি দক্ষিণ দিকটাই ভালো করে দেখা যাচ্ছে, সেদিকে যতদুরে চোখ যায় পাহাড় আর পাহাড় যেন ধাপে ধাপে নেমে যাচ্ছে অতলান্তিক মহাসাগরের বুকে। একটা নতুন শব্দের সাথে প্রথম পরিচয় হলো এই সময়। টিকিট কাউন্টারে দেখছিলাম লেখা আছে "Visibility limited due to Calima", এই কালিমা হলো গরম হাওয়া, নিচের দিকের পাথর গরম হয়ে সৃষ্টি এই কালিমার দরুন সামনের দৃশ্য অনেকটাই আবছা, অনেকটা যেন কুয়াশার বিপরীত। পায়ে হাঁটা রাস্তার দুদিকেই বড় বড় পাথরের স্তুপ, বাতাসে গন্ধকের চড়া গন্ধ, পৃথিবীর কেন্দ্রের সেই গলন্ত লাভায় মিশে থাকা গন্ধক পাথরে পরিনত হয়েছে। সামনের তিনটে পথের কোনটাতেই যাবার সময় বা অনুমতি নেই কাজেই আবার দাঁড়িয়ে পরলাম নিচে ফিরে আসার লাইনে, এবারো জানলার সামনের দিকে, তবে দক্ষিণে যেদিকে নামব সেদিকে মুখ করে। পায়ের নিচে পড়ে রয়েছে ১০০০মি পাহাড়। গায়ে কাঁটা দেয়া দৃশ্য আর পায়ের তলার আপাত ভারহীনতায় ভরা ৮ মিনিটে সেই দুরত্ব অতিক্রম করে আবার যাত্রা শুরু হলো দিনের শেষ গন্তব্যে, লস রোকেস দে গার্সিয়া (Los roques de García) আর য়ানো/যানো দে উকাঙ্কা (Llano de Ucanca), তেইদের কারপার্ক থেকে মাত্র পাঁচ মিনিট দুরে।
তেইদের চূড়া রোপওয়ের ওপরের প্রান্ত থেকে 
কেবল কার আর নিচের লাভায় তৈরী ভূমিরূপ 
তেইদের কার পার্ক থেকে পরের আকর্ষণ অনেকে হেঁটেও যায়, গাড়ি চলা রাস্তার থেকে দুরে একটা হাঁটাপথ আছে তেইদের পাদদেশের পাথুরে সমতলের মধ্যে দিয়ে। রাস্তার বাঁদিকে পারাদোরেস বটে একটা হোটেল, এমন অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে অবস্থিত এই হোটেলে রুমের চাহিদা বলাই বাহুল্য অশেষ, বিশেষ করে পর্বতারোহী হাইকারদের কাছে তেইদে আর তার চারপাশের এলাকা যখন স্বর্গোদ্যানের সমান। আসল চমক তবে রাস্তার ডানদিকে। মেন রাস্তা থেকে বাঁক নিয়ে এখানে রাস্তার দুপাশে গাড়ি রাখার জায়গা। ১০০-১৫০মি দৈর্ঘ্যের সেই রাস্তার শেষে এক ভিউয়িং পয়েন্ট। ডানদিকে উঁচিয়ে থাকা পাথরের স্তুপের পোষাকী নাম লস রোকেস দে গার্সিয়া। কেউ কেউ আবার বলে লা রুলেতা। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, গড়িয়ে আসা বিকেলের সূর্যের আলোয় এই পাথরের স্তুপের সৌন্দর্য অসামান্য। আগ্নেয় শিলার এই স্তুপের পরতে পরতে বিচিত্র সব রঙের খেলা। একদম ডানদিকে, তেইদের চুড়াকে পেছনে রেখে দাঁড়িয়ে আছে প্রবাদপ্রতিম এক প্রাকৃতিক শিলারূপ, তেইদে ন্যাশনাল পার্কের যে কোনো বর্ণনায় যার ছবি বা উল্লেখ পাওয়া যায়। পাথরের এই রাশির আকার অনেকটা উল্টোনো কমার মত, হাজার হাজার বছরের প্রাকৃতিক অবক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট এই অবয়ব যে কোনো ভাস্করের কৃতির সাথে পাল্লা দিতে পারে। পাশের পাথরের ঢিবির ওপর চড়ার ছোট ছোট ধাপ রয়েছে, কিছুটা ওপরে উঠতে পারলে চারদিকের দৃশ্য মন ভরিয়ে দেয়। উত্তরে শুকনো জমিতে বেড়ে ওঠা ঘাস আর ছোট ছোট ঝোপে ঢাকা সমতলভূমি চলে গিয়েছে তেইদের পাদদেশ অবধি। খানিকটা পশ্চিমে দেখলে রয়েছে পিকো বিয়েখো, আর দক্ষিণ পূর্বে অবস্থান করছে মন্তে গুয়াখারা (Mt Guajara)। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে দক্ষিনে তাকালে সামনের দৃশ্য অতিপ্রাকৃত। গুয়াখারার পেছন থেকে পর্বতের সারি বিস্তৃত পুরো দক্ষিন আর দক্ষিন পূর্ব দিক জুড়ে। তবে সেই পর্বত আর ভিউয়িং পয়েন্টের মাঝে ছেয়ে রয়েছে এক সুবিশাল সমতল ভূমি যার নাম য়ানো (স্পেনীয় উচ্চারণ) বা যানো (দঃ আমেরিকা) দে উকাঙ্কা।  রাস্তার উল্টোদিকে পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে সিঁড়ি তৈরী ভিউয়িং পয়েন্ট লস আজুলেখোস (Los Azulejos) যেখান থেকে উকাঙ্কা সমতলভূমিকে খানিকটা ওপর থেকে আরো ভালো করে দেখা যায়। ধু ধু করা সেই জমির থেকে উঠে আসছে হালকা কালিমা, মাঝে মধ্যে লাভাস্রোতে তৈরী বিচিত্র সব ঢেউ খেলানো আকার আর আগ্নেয় শিলারূপ - এসবের সমষ্টিতে তৈরী সুররিয়াল দৃশ্যকল্পের জন্য উকাঙ্কাকে মঙ্গল গ্রহের ভূমিরূপের সাথে তুলনা করা হয়। মন বিহ্বল হয়ে যায় এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে, মনে পড়ে যায় "মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকালমাঝে ..." 
রোকেস দে গার্সিয়ার শিলাস্তুপ 
রোকেস দে গার্সিয়া / লা রুলেতা আর পেছনে তেইদে পর্বত 
য়ানো/যানো দে উকাঙ্কা (উকাঙ্কা সমভূমি)
সম্বিত ফিরে আসে জেনিফারের ফোন সোফিয়ার জলের কাপে পড়ে যাওয়ায়। এবার ফেরার পালা, মন যদিও চায় এই বিশালতার মাঝে দাঁড়িয়ে নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করতে। ফেরার পথে আর দাঁড়ানো নয়, সোজা পুয়ের্তো দে লা ক্রুজ। দেখা হলনা অনেক কিছুই —তেইদের জ্বালামুখ, ভোরের সেই ত্রিভুজ ছায়া, স্পেনের সর্বোচ্চ গ্রাম বিলাফ্লোর (Vilaflor), গুয়াখারার বিপরীত ঢালে অবস্তিত পাইসাখে লুনার (Paisaje Lunar) বা চান্দ্রেয় ভূমিরূপ, তেইদে থেকে রাতের আকাশ - তবে সেসব তোলা রইলো ভবিষ্যতের জন্য, সোফিয়া একটু বড় হলে আবার আসা যাবেখন। ফেরার পথ যদিও একই রাস্তা, দুরত্ব মনে হচ্ছে যেন তিনগুন, আর উৎরাইতে গাড়ি চালানোও কঠিন। পাইন অরণ্য ছাড়িয়ে আগুয়ামান্সার কাছে আবার এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। ওরোতাবা উপত্যকার গা ঘেঁষে নেমে আসা রাস্তা তখন মেঘে ঢাকা। ফগ লাইট জ্বালাতে হলো গাড়িতে, এরকম চলল বেশ কিছু মাইল প্রায় খোদ ওরোতাবা শহর অবধি। ততক্ষণে পাহাড়ের গা জুড়ে লেগে থাকা মেঘের দেয়ালের ওপর থেকে নিচ পুরোটাই ছাড়িয়ে নিচে দেখা যাচ্ছে মেঘে ঢাকা পুয়ের্তো দে লা ক্রুজ। প্লেনে চড়ার সময় এরকম অনুভূতি হয় জানি যেখানে মেঘের নিচে অন্ধকার অথচ ওপরে সব পরিস্কার, কিন্তু রাস্তাতেও যে এরকম ঘটনার সাক্ষী হতে হবে কখনো ভাবিনি। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতামনা যে মেঘে ঢাকা বিমর্ষ করে দেয়া সেই বিকেলে মেঘের সীমানা ছাড়িয়ে এমন জায়গাও আছে ওপরের দিকে যেখানে আকাশ নীলে নীলাকার, সেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা খুঁজলেও এক টুকরো মেঘ চোখে পড়বেনা।  একটা দার্শনিক উপলব্ধি হল যে এই ধারনাটা আমরা আমাদের জীবনেও প্রয়োগ করতে পারি - যখন পরিস্থিতি প্রতিকুল, মন বিষন্ন তখন এই বিকেলটার কথা মনে করে মনকে বলা যেতেই পারে যে ওপরের ওই মেঘের রাশি, জীবন সেখানেই সীমিত নয়, প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে মাথা তুলে মেঘের ওপারে তাকালেই সেখানে তখন ঝলমলে এক দিন, নীল আকাশ বিরাজ করছে। খালি মনে বিশ্বাস বজায় রাখতে হবে যে সেটা সম্ভব।

যখন এই লেখাটা লিখতে বসেছি প্রায় দুসপ্তা সময় পার হয়ে গেছে। জীবন ফিরে এসেছে আবার সেই গতানুগতিকে - অফিসের চাপ, আর্থিক চিন্তা, সাংসারিক টানাপোড়েন জীবনকে আবার গ্রাস করে নিয়েছে। কিন্তু মনের মধ্যে রয়ে গেছে সূর্যালোকে ঝলমল করা উষ্ণ তেনেরিফের দিনগুলো বিশেষ করে সেই ৫ই অক্টোবরের স্মৃতি।  সেখান এখনো অমলিন হয়ে বিরাজ করছে তেইদের অভ্রংলীহ চূড়া, কেবল কারের রোমহর্ষক যাত্রা, উকাঙ্কার অপ্রাকৃত ভূমিরূপ আর রোকেস দে গার্সিয়ার অনবদ্য শিলারূপগুলো। সেই স্মৃতিগুলো যা মনে করিয়ে দেবে যে দৈনিক টানাপোড়েনের শেষে আবার এসে যাবে একটা ছুটি, আবার একটা হাতছানি পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে লুকিয়ে থাকা অন্য কোনো অপার্থিব অভিজ্ঞতার। এখনো অনেক দেরী তার তবে এক এক দিন করে ঠিকই কেটে যাবে একটা গোটা বছর, ততদিন তো রইলই তেইদের সঙ্গ…

পরিশেষ: সাধারণত ভ্রমনের অভিজ্ঞতা আমি লিখি ডায়েরিতে, খুব কম লেখাই আছে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে। বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপে ক্যানারী দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে অনেকেই জানে আর  আসাটা খুবই প্রচলিত। অন্যদিকে বাঙালী সমাজে ইউরোপ বেড়ানোর চল মুদ্রাহারের তারতম্যের জন্য বেশ বিরল, তবু স্বচ্ছল পরিবারের মানুষরা বেড়াতে যায় সাধারণত আর পাঁচটা দর্শনীয় জায়গা বলে আমরা যেগুলো সারা জীবন জেনে এসেছি, যেমন লন্ডন, প্যারিস, দক্ষিন ফ্রান্স, ইতালি গ্রীস সুইজারল্যান্ড। স্পেন বেড়ানোর তেমন চল যে আছে তা দেখিনি, আর থাকলেও সেটা মূল ভূখন্ডেই সীমাবদ্ধ মাদ্রিদ, সেবিলা, বার্সেলোনা, মালাগা। সুদুর অতলান্তিকের ক্যানারী দ্বীপপুঞ্জে বাঙালি পর্যটক আশা করাটা দুষ্কর আর অভিজ্ঞতাও সেটাই দেখালো। ভারতীয় টুরিস্ট একজনও দেখেছি বলে মনে করতে পারছিনা। কিছু ভারতীয় বংশোদ্ভূত পরিবার থাকে তেনেরিফেতে, পেশায় মূলত ব্যবসায়ী কিন্তু সেই অবধিই। বাঙালীদের সাথে সাক্ষাত হয়নি বললে ভুল হবে। ইংল্যান্ডের মত অসংখ্য না হলেও তেনেরিফেতে গোটাকয় ভারতীয় রেস্তোরাঁ আছে যেগুলো চালায় সিলেটি বাংলাদেশীরা। বাঙলার সাথে ওটুকুই যা যোগাযোগ। সে কথা ভেবেই এ লেখার অবতারণা যাতে অতলান্তিক মহাসাগরের বুকে আগ্নেয় পর্বতে ঘেরা সেই তেনেরিফের একটা চিত্র তুলে ধরা যায় বাঙালিদের কাছে। 

Monday 12 October 2015

ক্রস কানেকশান: একটি রহস্য নাটিকা

সে একটা নাটক শুনেছিলাম বটে একদিন। তখন বাড়িতে টিভি আসেনি আর তেমন বড় হইনি যখন বন্ধুদের সাথে ছুটির দিন পাড়ায় টো টো করে ঘুরবো। রবিবারগুলো কাটত হয় যোধপুর পার্কে মামার বাড়ি জেঠুর বাড়িতে নাহয় সকালে পাড়ায় পাশের বাড়ি মহাভারত দেখে ১১টা থেকে খানিক আড্ডা মেরে বা ক্রিকেট খেলে ১টায় বাড়ি তারপর চান খাওয়া সেরে রেডিও খোলা। কোন কোন রোববার সারা সকালটাই রেডিও শুনে কাটত। শুধু কানে শুনে সব ব্যাপারগুলো বোঝার চেষ্টা করার জন্য কল্পনাশক্তি অনেক জোরালো ছিল — পুরো ঘটনাগুলো চোখের সামনে ঘটতে দেখতে পেতাম। এরকম এক রবিবার দুপুরে খুব সম্ভব ২টো ৪৫য়ে কলকাতা ক'য়ে একখানা নাটক শুরু হল। পঁচিশ বছরেরও আগে শোনা সেই নাটকের কথা ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। কার লেখা কে মুল চরিত্রায়ন করেছিল সেসব একদম মনে নেই তবে সেই নাটকের ছায়া অনুসরন করে এই নাটিকা লেখার প্রচেষ্টা। একটাই অঙ্ক দৃশ্যও ধরতে গেলে একটাই। 

স্থান: লেকের উল্টোদিকে এক ফ্ল্যাটবাড়ি।  
সময়: আশির দশকের শেষের দিকে জানুয়ারি মাস রবিবার দুপুর দুটো 

শ্রীমতি সরকার খবরের কাগজ পড়ছেন বারান্দায় বসে, বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। বিধবা, একাই থাকেন এই বহুতল ফ্ল্যাটে। ছেলে সংসার নিয়ে বিদেশে। এক কাজের লোক আসে লক্ষ্মীকান্তপুরের দিক থেকে সে এখন দু সপ্তার ছুটি নিয়ে দেশে। এই কদিন তাই রান্নাটা নিজেকেই করতে হচ্ছে শ্রীমতি সরকারকে। সকাল থেকে ঝাড়পোঁছ শেষ করে দুপুরের খাওয়াটা সেরে সবে বসেছেন আনন্দবাজারটা নিয়ে। ছেলের ফোন করার কথা কিন্তু কদিন থেকে ফোনটা যা ঝামেলা করছে এক্সচেঞ্জ একদিন ঠিক থাকে তো দুদিন ডাউন। কাগজের ভেতরের পাতায় এক বাড়িওয়ালার খুনের খবর বেরিয়েছে। 

শ্রীমতি সরকার (স্বগতঃ) : আবার একটা খুন! কি দিনকাল পড়েছে কাউকে বিশ্বাস করা যায়না। শেষে বিশ বছরের পুরনো কাজের লোক এভাবে ধোঁকা দিল? নাঃ পাহারাদার রাখার প্রস্তাবটা ভেবে দেখতে হচ্ছে ফ্ল্যাটের সবাই টাকা দিলে কত আর লাগবে? স্বস্তিতে থাকা যাবে অন্তত। দেখি ডায়াল টোনটা এলো কিনা যা ভোগাচ্ছে এ কদিন। 

(শ্রীমতি সরকার বসার ঘরে গিয়ে কাঠের দেয়াল ইউনিটে ঢাউস রঙিন টিভির পাশে রাখা ফোনের রিসিভারটা তুললেন। ডায়ালটোন পাওয়া গেছে)

শ্রীমতি সরকার (স্বঃ) : এই তো কাজ করছে! ছেলেটা ফোন করলে হয় আবার বিগড়ে যাবার আগে। দেখি মৌসুমীকে ফোন করি অনেকদিন আসেনি এদিকে। 

মৌসুমী শ্রীমতি সরকারের ভাইঝি। ঢাকুরিয়ায় বাড়ি মাঝে মধ্যেই এসে দেখা করে যায় পিসির সাথে। 

(ফোনে হঠাৎ এক পুরুষকন্ঠের স্বর ভেসে এলো।  রুক্ষ কর্কশ গলা। বেশ শাসানোর স্বরে আর কাউকে কিছু বলছে। ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা কি কথা হচ্ছে। আবার শোনা গেল দ্বিতীয় এক কন্ঠ।)

শ্রীমতি সরকার : (স্বঃ) উফ আর পারা গেলনা। ভাবলাম ফোন টা ঠিক হয়েছে তা না আবার ক্রস কানেকশন। 
শ্রীমতি সরকার : এই যে ভাই এটা ক্রস কানেকশন হয়েছে আপনাদের আবার ফোন করতে হবে।  

প্রথম কন্ঠ : এই দাঁড়া তো! শুনতে পেলি কারো গলা?
দ্বিতীয় কন্ঠ : না বস লাইনটা গড়বড় করছে বহুত। তুমি বলো। 

(এবার গলা দুটো অনেক স্পষ্ট। শ্রীমতি সরকার দুটো কথাই শুনতে পেলেন।)

শ্রীমতি সরকার : (একটু জোরেই) ক্রস কানেকশন ভাই, শুনতে পাচ্ছেন? 

শ্রীমতি সরকারের কথার মাঝেই প্রথম কন্ঠ আবার কথা শুরু করে দিল।  বেশ জোরালো গলা, শুনে মনে হয় লোকজনকে হুকুম করে করে অভ্যস্ত। 

প্রথম কন্ঠ : তুই সাবধানে কাজ শেষ করবি লোকজন যেন টের না পায়।  কাজ হাসিল করে কদিন গায়েব হয়ে যেতে হবে তোকে। টাকার চিন্তা করিসনা আমি রেখে আসব গনেশের কাছে। পুলিশ যেন একদম সন্দেহ না করে।  

পুলিশের কথায় মিসেস সরকারের একটু আগ্রহ জাগলো। চুপ করে শুনতে লাগলেন কি বলছে লোকদুটো।  কথাবার্তার ভাবগতিক মোটেও ভালো ঠেকলনা শ্রীমতি সরকারের। 

প্রথম কন্ঠ: আমি কভার করব তোকে ভয় নেই।  আমি রাস্তায় দাঁড়াবো কান খাড়া রাখিস বেগতিক দেখলেই সিটি মারব সাথেসাথে বেরিয়ে আসবি কিন্তু দৌড়োবিনা।  এমনিতে এই সময় সাদার্ন অ্যাভিনিউ ফাঁকাই থাকে চুপচাপ কাজ গুটিয়ে বিকেল গড়ানোর আগেই কেটে পড়তে হবে।  
দ্বিতীয় কন্ঠ: গুরু খবর পাকা তো শুধুমুধু হানা মেরে খালি হাতে ফিরতে হবেনা তো?
প্রথম কন্ঠ: সেসব নিয়ে চিন্তা করিসনা খবর একদম পাকা। তুই শুধু যা করতে বলেছি ঠান্ডা মাথায় সেরে ফেলবি, কথার নড়চড় হবেনা আমার ষাট তোর চল্লিশ। 

শ্রীমতি সরকারের উৎকন্ঠা বেড়ে গেল।  লোকগুলো তো অবশ্যই কোনো বদ মতলব আঁটছে। ঠিক করলেন খানিকক্ষণ শুনবেন কি বৃত্তান্ত তারপর পুলিশকে ফোন করা যাবেখন। চুপ করে শুনতে লাগলেন। 

দ্বিতীয় কন্ঠ: বস সাবাড় করতেই হবে না মুখ চোখ বেঁধে ফেলে আসবো?
প্রথম কন্ঠ: এই হারামি এতবার করে বললাম শেষে তুই এই বুঝলি? সালা জানে না মারলে পুলিশ তো আসবে, তোকে কিরম দেখতে তার ছবিও একটা বানাবে, তারপর তোর্ ধরা পড়তে আর কতদিন? ছেনালীপনা বন্ধ কর, ফ্ল্যাটে ঢুকবি মুখ চেপে ধরে বাঁধবি চিল্লাতে না পারে মত তারপর মাল হাতিয়ে মালিককে সাবাড় করবি। যতদিনে পুলিশ বা পড়শি দরজা ভেঙ্গে ঢুকবে ততদিনে সব সোনা গালিয়ে বাজারে চালান হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় কন্ঠ: আরে দাদা রেগে যাচ্ছ কেনো? কোনো চিন্তা নেই একলা মানুষ তো আরামসে কাজ হয়ে যাবে। সেই বেলেঘাটার বুড়োটার মত তো আর হবেনা। 

ফোনটা আবার গন্ডগোল করছে। লাইনে কড়কড় আওয়াজ আসছে।

প্রথম কন্ঠ: নে নে ... দেরী করিসনা। সবকিছু ... ... ... নিয়েছিস তো? 
দ্বিতীয় কন্ঠ: হ্যাঁ সব আছে ওস্তাদ। ফ্ল্যাটের চাবি যন্তর … …
প্রথম কন্ঠ: ঠিকানা মনে … …
দ্বিতীয় কন্ঠ: হ্যাঁ হ্যাঁ বস একশো … … দার্ন অ্যাভিনি… সব আমার এলাকা চোখ বন্ধ …… যেতে পারি। 
প্রথম কন্ঠ: নে নে আর ক্যালি … … হবেনা। ঠিক তিন … … বাড়ির পাশের … রোডে  আমি দাঁড়িয়ে … …
দ্বিতীয় কন্ঠ: ঠিক আছে গুরু … …

(লাইন কেটে গেল। খালি মিসেস সরকারের ফোন তখনো কড়কড় করছে। রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন)

শ্রীমতি সরকারের মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরছে। চোখে মুখে আতঙ্ক। একে প্রেসারের রোগী তার ওপর হঠাৎ করে এমন এক ভয়ঙ্কর খবর।  নম্বরটা শুনতে পেলেননা ফোনে কিন্তু শ্রীমতি সরকারের বাড়ির নম্বর একশ তিরাশি, তার মানে বাড়ির কাছাকাছিই। কি করবেন ঠিক করে উঠতে পারছেননা। লোকটা বলল বিকেলের মধ্যে কাজ সারবে তার মানে এক দেড় ঘন্টার মধ্যে বাড়ির কাছাকাছি একটা খুন বা ডাকাতি ঘটবে। 

(দেয়াল ইউনিট ধরে দাঁড়ালেন খানিকক্ষণ। ধাতস্থ হয়ে গেলাসে জল ঢেলে খেলেন অল্প একটু)

শ্রীমতি সরকার (স্বঃ): কি সাংঘাতিক। ঘরের দোরগোড়ায় খুন! এ হতে দেয়া যায়না। 

(ফোন ডায়াল করলেন থানায়)

শ্রীমতি সরকার: হ্যালো, লেক থানা? 
পুলিশ অফিসার: বলছি। আপনার নাম?
শ্রীমতি সরকার: আমার নাম বসুন্ধরা সরকার, একটা খুব জরুরি খবর আছে। 
পুলিশ অফিসার: কি ব্যাপার বলুন। 
শ্রীমতি সরকার: আমি এইমাত্র ফোনে ক্রস কানেকশন হয়ে দুজন লোকের কথা শুনতে পেলাম। তারা সাদার্ন অ্যাভেনিউর এক ফ্ল্যাটে ডাকাতি আর মালিককে খুনের ফন্দি করেছে।  
পুলিশ অফিসার: ইন্টারেস্টিং, একটু খুলে বলুন ক্রস কানেকশন কিকরে হলো?
শ্রীমতি সরকার: আমাদের এক্সচেঞ্জটা কাজ করছেনা কয়েকদিন, ফোনে প্রায়ই গন্ডগোল। এখুনি ডায়ালটোন খুঁজতে গিয়ে গলা দুটো শুনতে পেলাম। আজ দুপুরে তারা কোনো একটা বাড়ি ঢুকে মালিককে খুন করে বাড়ির সব সম্পত্তি হাতানোর কথা বলছিল।  
পুলিশ অফিসার: এই বললেন ফ্ল্যাট আবার বলছেন বাড়ি ঠিক কি বলল লোকগুলো?
শ্রীমতি সরকার: না না ফ্ল্যাটই বলল।   
পুলিশ অফিসার: আচ্ছা। লোকগুলোর নাম শুনতে পেলেন?
শ্রীমতি সরকার: না তবে একজন ভারি গলা আর অন্যজন একটু কম বয়েসের মনে হয়।  ভারী গলা মনে হয় প্ল্যান করছে সব।
পুলিশ অফিসার: কোন বাড়ি, কি নাম কিছু শুনতে পেলেন?
শ্রীমতি সরকার: না না লাইনটা আবার বিগড়ে গেল যে।  বলল একশ কিছু একটা, সাদার্ন অ্যাভিনিউই মনে হয় বলল, ঠিক শুনতে পেলামনা।
পুলিশ অফিসার: ম্যাডাম ঠিক শুনেছেন তো, এই তো বললেন আদ্ধেক শুনতে পাননি। 
শ্রীমতি সরকার: না প্রথম দিকে তো ক্লিয়ারই ছিল।  দেখুন আপনারা তাড়াতাড়ি কিছু করুন দয়া করে, এরা তো খুনের কথা বলছে। 
পুলিশ অফিসার: আচ্ছা আচ্ছা দাঁড়ান ওসির সাথে কথা বলে দেখি। লাইনে থাকুন।
শ্রীমতি সরকার: আচ্ছা।

শ্রীমতি সরকার অধৈর্য্য হয়ে উঠলেন কিন্তু আর যে কি করবেন ভেবে পাচ্ছেননা। প্রায় পাঁচ মিনিট কেটে গেল পুলিশের সাড়াশব্দ নেই। 

(ফোনের রিসিভারটা ধরে অস্থির পায়ে খানিক হাঁটতে শুরু করলেন। পুলিশ অফিসারের গলা শুনতে পাওয়া গেল আরো ২-৩ মিনিট পর। 

পুলিশ অফিসার: ম্যাডাম আচ্ছেন নাকি লাইনে?
শ্রীমতি সরকার: হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন। কি বললেন ওসি?
পুলিশ অফিসার: দেখুন ম্যাডাম আপনি তো ঠিকঠাক কোনো ইনফরমেশনই দিতে পারছেননা। ঠিকানা শুনতে পাননি, ফ্ল্যাটের নম্বর ঠিক জানেননা, মালিকের নাম শোনেননি, কোন ভরসায় তদন্ত করা শুরু করি বলুন তো?
শ্রীমতি সরকার: যা যা শুনলাম বললাম তো আপনাকে। 
পুলিশ অফিসার: দেখুন অপরাধ নেবেননা। হয়ত কেউ ফোনে মস্করা করেছে সেটাও তো হতে পারে?
শ্রীমতি সরকার: একদন না, যেভাবে লোকগুলো কথা বলছিল...
পুলিশ অফিসার: তাতে কিছুই প্রমান হয়না। আপনার বাড়ির নম্বরটা কি যেন বললেন?
শ্রীমতি সরকার: একশ তিরাশি। ছতলায় ফ্ল্যাট এগারো।
পুলিশ অফিসার: দেখুন ওদিকটা তো গোলপার্ক থানা, আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে। আপনি বরং গোলপার্ক থানায় একটা ফোন করুন।
শ্রীমতি সরকার: কি আশ্চর্য মানুষের জীবনমরণ সমস্যা আর আপনারা এলাকা দেখাচ্ছেন?
পুলিশ অফিসার: দেখুন আপনার দেয়া তথ্যে কাজ করা যায়না। তাছাড়া রোববারের বাজার থানায় লোকই নেই যে টহলে পাঠানো যাবে। গোলপার্ক থানায় করুন ওরা কিছু করতে পারে কিনা দেখুন। আচ্ছা ধন্যবাদ।

(কিছু বলার আগেই ফোন কেটে গেল কট করে।) 

শ্রীমতি সরকার: হ্যালো হ্যালো?...কি ছোটলোক!

শ্রীমতি সরকার খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন রিসিভারটার দিকে, যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেননা যে পুলিশ অমনভাবে লাইন কেটে দিতে পারে।

(এই সময় আড়াইটের ঘন্টা বাজলো দেয়াল ঘড়িতে ঢং করে। খানিকটা চমকে উঠে ঘড়ির দিকে দেখলেন শ্রীমতি সরকার।)

শ্রীমতি সরকার: (স্বঃ) আড়াইটে বেজে গেলো? গোলপার্কের পুলিশগুলোও এরকমই হবে নাতো? দেখা যাক। 

(ডাইরেক্টরি খুঁজে গোলপার্ক থানার নাম্বার যোগাড় করে ডায়াল করলেন)

পুলিশকন্ঠ: গোলপার্ক থানা এসি সুমন আচার্য বলছি। 
শ্রীমতি সরকার: হ্যালো আমার নাম বসুন্ধরা সরকার। খুব জরুরী ব্যাপার। 
এসি: বলুন মিসেস সরকার কী সাহায্য করতে পারি?
শ্রীমতি সরকার: একটু আগে আমার ফোনে ক্রস কানেকশন হয়ে গিয়েছিল। দুজন লোক সেখানে কাউকে খুন করে তাদের ফ্ল্যাটে ডাকাতি করার প্ল্যান করছিল। আজ দুপুরেই কাজ সারবে বলছিল। আমি লেক থানায় ফোন করলাম ওরা বলল কিছু করতে পারবেনা আপনাদের থানায় ফোন করতে হবে। তাড়াতাড়ি কিছু করুন। 
এসি: হ্যাঁ লেক থানার একটু দুর্নাম আছে এ ব্যাপারে আমাদের থানায় কেস দায়ের করানোর। খুলে বলুন একটু কি শুনেছেন ক্রস কানেকশানে?
শ্রীমতি সরকার : দুজন লোক কথা বলছিল, একজন মনে হয় আসল মাথা অন্যজন অর্ডার নিচ্ছিল কি করতে হবে।  সাদার্ন অ্যাভিনিউর একশ কিছু নাম্বারের বাড়িতে ডাকাতি করবে, মালিককে মেরে ফেলে বাড়িতে সোনাদানা লুঠ করবে। 
এসি : হুম এতো বেশ সিরিয়াস ব্যাপার। লোকগুলোর গলা শুনলে চিনতে পারবেন?
শ্রীমতি সরকার : হ্যাঁ তা ঠিক পারব। কিন্তু লোকগুলো তো বলছিল এই দুপুরেই কাজ সারবে।  আপনি কোনো পুলিশ লাগাতে পারবেন না? পুলিশ দেখলে হয়ত প্ল্যান পাল্টাতে বাধ্য হবে।  
এসি : সে আমরা দেখছি। রবিবারে এমনিতে কম পুলিশ থাকে থানায়, এমার্জেন্সি ছাড়া গাড়ি ইয়ুজ করিনা তবে খুনের ব্যাপার তো সিরিয়াস। আর কোনো ক্লু শুনতে পেলেন? বাড়ির নাম্বার বা নাম?
শ্রীমতি সরকার : নাহ। বাড়ির নাম্বার একশ তারপর কি বলল শুনতে পাইনি ঠিক।  লাইনটা আবার গন্ডগোল করছিল। কিন্তু নাম্বারের পর সাদার্ন অ্যাভিনিউ পরিস্কার শুনলাম। দুজনে বাড়ির পাশের কোন এক রোডে মিট করবে। তবে বলছিল যদ্দিনে পুলিশ ফ্ল্যাটে ঢুকবে সোনাদানা ততদিনে গালিয়ে বাজারে পাচার হয়ে গেছে।  আর যে ডাকাতি করবে সে আগেও অনেক এরকম কাজ করেছে আর খুনও করেছে। যে সাগরেদ সে কদিন গায়েব হয়ে যাবে কিন্তু ভাগ গনেশ বলে কারো কাছে থাকবে। 
এসি : বটে, তাহলে তো পুরনো পাপী। তবে গয়না গালিয়ে বাজারে চালান ক্রিমিনালদের রেগুলার প্রসেস...গনেশ নামটা খতিয়ে দেখতে হবে লোকাল ক্রিমিনাল লিস্টে। 
শ্রীমতি সরকার :  আর হ্যাঁ, বলছিল বেলেঘাটার কোনো বুড়ো নাকি খুব ট্রাবল দিয়েছিল এদের। 
এসি : (চমকে) বেলেঘাটার বুড়ো?!!! আপনি স্পষ্ট শুনেছেন তো?
শ্রীমতি সরকার : হ্যাঁ কেনো এটা কোনো ক্লু বুঝি?
এসি : বেলেঘাটায় রিসেন্টলি একটা নৃশংস খুন হয়।  এক বুড়ো মানুষের ফ্ল্যাটে দুজন লোক ডাকাতি করতে যায়।  ভদ্রলোক এক্স সার্ভিসম্যান, ডাকাতদের বিনা মোকাবিলায় যেতে দেননি। শেষে এত শব্দ হয় যে পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন হাঁক মারতে থাকে, ডাকাত দুজন পালিয়ে যায় কিছু না হাতিয়েই। বৃদ্ধ অনেক ছুরির আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।  কিন্তু সারভাইভ করতে পারেননি শেষ পর্যন্ত। তবে পুলিশকে স্টেটমেন্ট দেন মারা যাবার আগে, আর পাড়ার লোকজনদের কাছে থেকে ডাকাতদের একটা আইডিয়াও পাওয়া যায়।  
শ্রীমতি সরকার : কি সাংঘাতিক!!
এসি : হ্যাঁ। এটা কলকাতা পুলিশের একটা বড় তদন্ত। সব থানাই মোটামুটি জানে কেসটার ব্যাপারে। আপনার তথ্য অনুযায়ী এরাই তাহলে সেই দল মনে হচ্ছে। তবে শুনে তো মনে হচ্ছে শুধু দুজন লোক অপারেট করছে, আমাদের ধারণা ছিল অর্গানাইজড ক্রাইম। কম লোকের গ্যাং ধরা কঠিন। 
শ্রীমতি সরকার : তাহলে তাড়াতাড়ি কিছু করুন। এক দেড়ঘন্টা তো বাড়ি বিকেল হতে।  
এসি : হ্যাঁ হ্যাঁ আমি দেখছি কি করা যায়।  এখুনি টিম তৈরী করছি। আপনি আপনার ডিটেলস গুলো একটু বলুন ডায়রি করার জন্যে।
শ্রীমতি সরকার : লেক থানাকেও তো দিলাম ডিটেলস। শুরু করুন তবে। 
এসি : স্ট্যান্ডার্ড প্রসেস ম্যাডাম। আপনার নামটা আর একবার বলুন। সরকার বললেন তো?
শ্রীমতি সরকার : হ্যাঁ। বসুন্ধরা সরকার।
এসি : বাড়ির ঠিকানা?
শ্রীমতি সরকার : একশ তিরাশি সাদার্ন অ্যাভিনিউ। ছ তলায় ফ্ল্যাট এগারো। 
এসি : ওকে। আর আপনি বলছিলেম যে বাড়িতে ডাকাতি করার প্ল্যান সেটাও একশোর ঘরের নাম্বার?
শ্রীমতি সরকার : হ্যাঁ সেরকমই তো শুনলাম। 
এসি :তাহলে তো আপনার বাড়ির আশেপাশে। ছতলা বললেন না? আপনি আমাদের হেল্প করতে পারেন বারান্দা থেকে সন্দেহজনক কোনো অ্যাকটিভিটি দেখলে পুলিশকে খবর দিতে পারেন।
শ্রীমতি সরকার : ঠিক আছে আমি চোখ রাখবো রাস্তায়। 
এসি : থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। গ্রুপটাকে হাতেনাতে ধরতে পারলে আপনার একটা পুরস্কারও জুটতে পারে দু হাজার টাকা কোলকাতা পুলিশ থেকে। 
শ্রীমতি সরকার : আমার আর এই বয়সে টাকাপয়সার দরকার নেই ভাই। একা থাকি বাড়িতে পাড়ার আশপাশটা যদি নিরাপদ থাকে সেটাই নিশ্চিন্তি। 
এসি : হুঁ। আপনি একা থাকেন তাহলে ফ্ল্যাটে?
শ্রীমতি সরকার : হ্যাঁ একাই আপাতত। কাজের একটা মেয়ে থাকে সারাদিন সে এখন ছুটিতে। 
এসি : ওকে। আপনি যখন একা বাড়িতে একটু এক্সট্রা কেয়ারফুল থাকবেন। নাম না জিগ্যেস করে দরজা খুলবেননা সে যখনই হোক না কেন। 
শ্রীমতি সরকার : আমি খুলিনা বিশেষ করে ইদানীং ফ্ল্যাটে ডাকাতি শুরু হবার পর আরোই না। কাজের মেয়েটাকেও শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছি। 
এসি : এক্সেলেন্ট। আচ্ছা ম্যাডাম আমি অপারেশন চালু করছি। আপনি নজর রাখুন। আচ্ছা ধন্যবাদ। 
শ্রীমতি সরকার : ধন্যবাদ। 

(ফোন কেটে গেল। শ্রীমতি সরকারের ভাবভঙ্গি অনেক আশ্বস্ত। ঘড়ি দেখলেন। তিনটে বাজতে দশ। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন যদি কিছু দেখা যায়।)

(বারান্দার বাইরে শীতের বিকেলের দৃশ্য। পড়ন্ত মিঠে রোদে লেকের জল ঝিলমিল করছে। দুরে বড় লেকে দুটো রোয়িং নৌকো প্র্যাকটিস করছে। রাস্তায় জনমানুষের চিহ্ন নেই। মাঝে হঠাৎ হুশ করে চলে গেল একটা ২২১ গোলপার্কের দিকে। দুরে কোনো মাঠে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে, ভেসে আসছে ব্যাটবলের ঠক ঠক শব্দ আর মাঝেমধ্যে হাউজ্যাট)

শ্রীমতি সরকারের মনটা খারাপ হয়ে গেল। শীতের এ কটা মাসই যা উপভোগ করা যায় গরম আর বৃষ্টি ছাড়া। এ সময়টা তিনি আয়েস করে এককাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসেন, এই নিরিবিলি বিকেলটা এনজয় করেন। কিন্তু এই দিনটা যে একেবারে অন্যরকম। এই অপরূপ শীতের বিকেলের পটভূমিতে ঘটতে চলেছে এক বর্বর হত্যাকাণ্ড। খানিকটা উত্তেজিতও হয়ে উঠলেন যদি সত্যিই পুলিশ ধরতে পারে খুনিগুলোকে। গোয়েন্দা গল্পের তেমন ভক্ত না হলেও লীলা মজুমদারের রোমাঞ্চকর গল্পগুলো মনে পড়ে গেল। কলকাতা পুলিশ কি সত্যি তাঁকে পুরস্কার দেবে?

(আনমনা হয়ে তাকিয়ে ছিলেন শ্রীমতি সরকার, চমক ভাঙলো ঘড়িতে তিনটে বাজতে। রাস্তার দিকে চাইলেন যদি কিছু দেখা যায়। গাছে ঢাকা সাদার্ন অ্যাভিনিউ যেন হলদে পাতার জালে জড়ানো। শ্রীমতি সরকার ব্যালকনি থেকে গোলপার্ক আর স্টেডিয়াম দুদিকেই দেখে নিলেন। রাস্তা যে কে সেই ফাঁকা।)

শ্রীমতি সরকার : (স্বঃ) আর কতক্ষণ যে বাকী! পুলিশের দেখা নেই এখনো। 

(অস্থির হয়ে ঘড়ির দিকে দেখলেন আবার। সবে তিনটে পাঁচ। শ্রীমতি সরকার অপেক্ষা করছেন কখন চারটে বাজবে। স্কুল ছুটি হলেই এদিকটা আবার জমজমাট। গোলপার্কের দিক থেকে একটা ২২১ দাঁড়াল শ্রীমতি সরকারের ফ্ল্যাটবাড়ি ছাড়িয়ে লেক কালীবাড়ি স্টপেজে। 

হঠাৎ চোখে পড়ল ২২১টা যেদিক থেকে এসেছিল সেদিক থেকে একটা সাইকেল আসছে। অন্য দিন হলে ঠাহর করে দেখতেননা কিন্তু আজ ভাল করে দেখতে হবে বলে নজরে রাখলেন। হতেও পারে এই খুনি কিম্বা প্লেন ড্রেসের পুলিশ। সাইকেলটা ডানদিকে ঘুরে কেয়াতলা রোডের দিকে মোড় নিল।)

শ্রীমতি সরকারের বারান্দা থেকে ওদিকটা দেখা যায়না কিন্তু বসার ঘরের অন্য জানলা গিয়ে পুরোটাই চোখে পড়ে। ফ্ল্যাটবাড়িটা দুই রাস্তার কোনে না হলেও কোনের তিনটে বাড়ি দুই আর তিনতলা তাই কেয়াতলা রোডের একটা ফুটপাথ পুরোটাই নজরে আসে। 

(শ্রীমতি সরকার বসার ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মারলেন কেয়াতলা রোডের দিকে। সাইকেলওয়ালা সাইকেল দেয়ালে দাঁড় করিয়ে অন্য একজন লোকের সাথে কথা বলছে। খানিক দুরে এক ফুচকাওয়ালা টিউকল থেকে জল ভরছে। লোকদুটো ফুচকাওয়ালার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে আবার কথা শুরু করল। সাইকেলওয়ালার পরনে চেক শার্ট হাতকাটা সোয়েটার খাকি প্যান্ট হাওয়াই চটি সাইকেলের হাতল থেকে একটা সাদা ব্যাগ ঝুলছে। অন্য লোকটার গায়ে নীল ফুলহাতা সোয়েটার জিনস স্পোর্টস শু অল্প টাক। কথা বলতে বলতে দুজনেই চারপাশের বাড়িগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে নিলো, শ্রীমতি সরকারের ফ্ল্যাটের দিকেও দেখল, শ্রীমতি সরকার ঝট করে সরে এলেন। মনে হয় এতো দুরে দেখতে পায়নি তাঁকে।)

(শ্রীমতি সরকার ফোন তুলে ডায়াল করলেন গোলপার্ক থানা। ডায়াল করে রিসিভারটা কানে তুললেন। ফোন আবার ডেড, কোনো ডায়ালটোন নেই। খালি মাঝেমধ্যে কড়কড় আওয়াজ)

শ্রীমতি সরকার : (স্বঃ) উঃ ঠিক যখ্খুনি দরকার তখনই ফোনটা আবার গেল? কোন কাজে আসেনা ক্যানসেল করে দেব সামনের মাসে। মরতে ক্রস কানেকশানটাই যে কেন হতে হল, কলটা না শুনলে তো পুরো রবিবারের বিকেলটা এমন বরবাদ হতনা। 

(আবার বসার ঘরের জানলা দিয়ে চাইলেন। লোকদুটো গায়েব। ফুচকাওয়ালা জল নিয়ে অনেকটা দুরে এখন। শ্রীমতি সরকারের কেন যেন মনে হচ্ছে ওই দুটো লোকই কালপ্রিট। ঘড়ির দিকে তাকালেন আবার। সময় যেন থেমে গেছে ঘড়িটায়। সোয়া তিনটেও বাজেনি এখনো। পুলিসকে আবার ফোন করার জন্য ফোন তুললেন। ডায়ালটোন নেই। বারান্দায় গিয়ে নিচের দিকে চাইলেন। নীল সোয়েটার সাদার্ন অ্যাভিনিউর ওপারে কেয়াতলা রোডের মোড়ের উল্টোদিকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছে। সাইকেলওয়ালাকে দেখা যাচ্ছেনা)

(গোলপার্কের দিক থেকে হঠাৎ দেখা গেল একটা পুলিশ জিপ। শ্রীমতি সরকার একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।) 

শ্রীমতি সরকার : (স্বঃ) বাঁচাল তবে! এসি লোকটা তাহলে কথা রেখেছে। পুলিসকে এখনো ভরসা করা যায়। অন্য লোকটা কোনদিকে গেল কে জানে। 

(নীল সোয়েটারকে একটু অস্থির দেখাচ্ছে। চট করে সিগারেট ফেলে পকেটে হাত ঢোকালো। পুলিশ গাড়ি কিন্তু  থামলোনা। বরং হুশ করে চলে গেল শরৎ বোস রোডের দিকে। নীল সোয়েটার আবার আরাম করে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। দেখে মনে হচ্ছে লোকটা কেয়াতলা রোডের দিকেই তাকিয়ে আছে। সাইকেলওয়ালা তাহলে ওদিকেই গেছে মনে হয়। শ্রীমতি সরকার অন্য জানলার দিকে গেলেন।)

(কেয়াতলা রোড শুনসান। আরো ভালো করে দেখার জন্য ঝুঁকে দেখলেন জানলা থেকে। নিচে ফ্ল্যাটে ঢোকার মেন বড় গেট। আর একটু মাথাটা বাড়িয়ে দেখলে ফ্ল্যাটবাড়ির কমন উঠোন পেরিয়ে বাড়ির মেন এনট্রান্সটা দেখা যায়। সেদিকে একবার চাইলেন শ্রীমতি সরকার। দেখলেন সাদা ব্যাগ আর হাওয়াই চটি পরা একটা খাকি প্যান্ট পা উধাও হয়ে গেল বাড়ির ভেতরে।)

বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল শ্রীমতি সরকারের। মনে মনে ঝালিয়ে নিলেন লোকগুলো ফোনে যা বলছিল। সাদার্ন অ্যাভিনিউ, কেয়াতলা রোডে দেখা করার কথা, একশো তিরাশির বাড়ি। যে অংশগুলো শুনতে পাননি সেগুলো এখন খাপেখাপে জোড়া লেগে যাচ্ছে। 

(শ্রীমতি সরকার আবার ফোন ট্রাই করলেন। পুলিশ ভ্যানটা খুব বেশীদুর যায়নি হয়ত। রিসিভারে ডায়ালটোন শোনা যাচ্ছে। উদগ্রীব হয়ে সব বলার জন্য তৈরী হঠাৎ শোনা গেল সেই পরিচিত গলা "এই নম্বরটি এখন ব্যস্ত। দয়া করে একটু পর আবার ডায়াল করুন")

(শ্রীমতি সরকার অধৈর্য হয়ে বসার ঘরে পায়চারী করছেন।  আবার বারান্দায় গেলেন। যদি পুলিশ ভ্যান দেখেন চিৎকার করবেন। নীল সোয়েটার তখনো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। ঘড়িটা দেখে নিল একবার তারপর ওপর দিকে চাইল…)

শ্রীমতি সরকার : (স্বঃ) একী এ তো আমারই দিকে দেখছে।  তবে কী…

(লোকটা তাকানো শেষ করে হাঁটা দিল কেয়াতলা রোডের দিকে)

আতঙ্কে শ্রীমতি সরকারের রক্ত জল হয়ে গেল। এতক্ষণ তিনি ক্রস কানেকশানে কথা শুনে বিন্দুমাত্রও ভাবেননি যে এরা তাঁকেই মারার প্ল্যান করছে। খুন রোখার সঙ্কল্পে পুলিসকে ফোন করে রিপোর্ট করতে করতে তিনিও যে তাদের লক্ষ্য হতে পারেন সেটা একবারও ভাবেননি। তবু একবার আবার মনে করার চেষ্টা করলেন চব্বিশ ফ্ল্যাটের বাড়িতে আর কে কে একা থাকে। নীল সোয়েটার হয়ত গেল সাগরেদকে সাবধান করতে। 

(শ্রীমতি সরকারের চিন্তার জাল তছনছ হয়ে গেল পায়ের শব্দে। খুব হাল্কা শব্দ কিন্তু পরিস্কার। সিঁড়ি ভেঙে খসখস আওয়াজটা তাঁর দরজার সামনেই থামল। শুনতে পাচ্ছেন ঠুংঠাং চাপা ধাতব শব্দ।)

নড়াচড়ার কোন শক্তি আর নেই শ্রীমতি সরকারের। শুধু মনে পড়ে গেল তাঁর সব সোনাদানা ব্যাঙ্ক থেকে কদিন আগে তুলে এনেছিলেন অন্য ব্যাঙ্কে রাখবেন বলে, তাঁর নিজের সব গয়না তার ওপর ছেলের বৌয়ের কয়েকটা। মনে পড়ে যাচ্ছে কাজের মেয়ে ভারতীকে বলছেন পরের বার বলবেন ওদের গয়না যেন নিয়ে যায় সাথে করে। একলা মানুষ বাড়িতে, সোনাগয়না রাখা বাড়িতে–আসল টার্গেট যে তিনিই সেটা অনুমান করতে এত সময় লাগল। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। 

শ্রীমতি সরকার : (স্বঃ) না এ হতে পারে না… শেষে কিনা আমিই…(দৌড়ে বারান্দায় গেলেন)…বাঁচাওওও

(শ্রীমতি সরকারের চিৎকার তেমন জোরে শোনা গেলনা। গলা শুকিয়ে কাঠ। দরজার ইয়েল লকটা আস্তে আস্তে ঘুরে গেল। দরজাটা অল্প খুলতে দেখা গেল উল্টোদিকে নব ধরে আছে চেক শার্ট পরা একটা হাত…)

যবনিকা