সেটা ১৯৯৭ সালের কথা, তখন জলপাইগুড়িতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি প্রথম বর্ষে। বসন্ত কাল, পরীক্ষা-টরীক্ষা নেই কাছেপিঠে, হাতে তাই অফুরন্ত সময়। যারা প্রাকৃতিক দৃশ্য ভালবাসে, আমাদের ক্যাম্পাসটা তাদের জন্যে সোনায় সোহাগার মত। উত্তর দিকটা জুড়ে ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগান, সেদিকে তাকালে যতদুর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ, আর বাগানের বুক চিরে চলে গেছে রেললাইন উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর দিকে। পশ্চিম জুড়েও চাবাগান দুরে, তার আগে করলা নদীর ওপর রেলব্রিজ। ক্যাম্পাসের পশ্চিম আর পূর্ব দিক দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে করলা আর রুকরুকা দুই নদী। বসন্তকালে চা বাগানের দিক থেকে বয়ে আসে দারুন মৃদুমন্দ হাওয়া, উত্তর দিকে ডুয়ার্স আর তার ওপরে পূর্ব হিমালয়ের হাতছানি নিয়ে। যে রাতটার হাড় হিম করা ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা এখন লিখতে যাচ্ছি তার জন্যে এই বসন্ত কালের পরিবেশ ছিল আদর্শ পটভূমিকা।
আমাদের এক নম্বর হোস্টেলের একতলায় উত্তরের দিকে ছিল একটা বড় কমন রুম, যেখানে হোস্টেলের সবাই সময় কাটাতে আসত। কমন রুমে ছিল একটা কালার টিভি, গোটা তিন ক্যারাম বোর্ড আর সেই লিস্টে নতুন আমদানি একটা ঝাঁ চকচকে টেবিল টেনিস বোর্ড। কমন রুমের দরজার উল্টোদিকের দেয়ালে, টিভি স্ট্যান্ডের পাশে আরেকটা ছোটমত দরজা। সেই দরজার পেছনে একটা ছোট্ট ঘর, আমরা বলতাম নিউজ রুম। সে ঘরে ছিল খালি একটা দেয়াল জোড়া বড় টেবিল আর দুপাশে দু সারি বেঞ্চি। নিউজ রুমের পেছনের দেয়াল জুড়ে খড়খড়ি দেয়া জানলা, যেখানে তাকালে তিন নম্বর হোস্টেলের রাস্তা তার পর থেকে চা বাগান শুরু। নিউজ রুমটা ছিল হোস্টেলের পড়ুয়া ছেলেদের খবরের কাগজ পড়ার জায়গা। ঘরটা খোলা হতো ১২টা থেকে ৪-৫টা অবধি, শনি রবিবার আরেকটু আগে থেকে। তবে খুব বেশি লোকজন যে ব্যগ্র ছিল সারা বিশ্বের খবর জানার জন্যে তা বললে ভুল হবে। ঘরটা বেশির ভাগ সময় ফাঁকাই থাকত।
যে সালটার কথা বলছি সে বছর টেবিল টেনিস খেলার একটা ধুম পড়েছিল হোস্টেলের ছাত্রদের মধ্যে। স্পোর্টস ফান্ডের টাকায় এলো নতুন বোর্ড, তার সাথে বেশ কিছু নতুন ব্যাটও। আমরা ফার্স্ট ইয়াররা থাকতাম থার্ড ইয়ারের ছেলেদের সাথে, কাজেই কমন রুমে একটা অলিখিত নিয়ম ছিল যে থার্ড ইয়ারের ছেলেরা খেলা, টিভির সামনে সিট এসবে প্রথম চান্স পাবে। টেবিল টেনিসেও তাই লম্বা লাইন পড়ত খেলার জন্যে, সেখানে থার্ড ইয়ারের ছেলেদেরই অগ্রাধিকার, যদিনা কেউ দয়া করে ফার্স্ট ইয়ারের কুচোকাঁচাদের একটা গেম খেলতে দিতো। ফার্স্ট ইয়াররা খেলার চান্স পেত রাতের দিকে যখন সিনিয়াররা পরের দিনের সেশনাল বা ব্রিজের আসর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। আমার রুমমেট ছিল তথা – তথাগত বামুন, আমরা দুজনেই টেবিল টেনিস খেলার জন্যে খুব উৎসাহী ছিলাম কিন্তু রোজ রোজ অনেক রাত অবধি অপেক্ষা করেও খুচরো এদিক ওদিক এক-আধটা গেম ছাড়া কপাল খোলেনি। আমাদের তিন নম্বর রুমমেট বিক্রম ছিল তুখোড় টেবিল টেনিস খেলুড়ে তাই শেখার গরজটা আমাদেরই বেশি ছিল।
ঘটনার সূত্রপাত এরকমই এক রাতে যখন আমরা ঠিক করলাম যে যথেষ্ট হয়েছে সেই রাতে এসপার-ওসপার হয়ে যাবে। পরদিন ক্লাস থাকা সত্ত্বেও ঠিক করলাম যত দেরিই হোক না কেন সে রাতে কমন রুম ফাঁকা হওয়া অবধি অপেক্ষা করব তারপর টানা যতক্ষণ ইচ্ছে প্র্যাকটিস চালিয়ে যাব। প্ল্যান যে কাজ করছে সেটা বোঝা গেল সাড়ে এগারোটা নাগাদ কমন রুম ফাঁকা হতে শুরু করায়। ক্যারম বোর্ডের আলোগুলো একে একে নিভতে শুরু করলো, বোর্ড ঢাকা পড়ল নেভি ব্লু কভারে। টিভি তখনও চলছিল তবে দেখার লোক বলতে গোটা দুই। হাতে গোনা কয়েকজন ফার্স্ট ইয়ার রয়ে গেলাম টেবিল টেনিস খেলার জন্যে। প্রতিটা গেমের পর অন্যদের সাথে হাত বদল করছিলাম কিন্তু সবাই আনাড়ি তাই একটা গেম পাঁচ দশ মিনিটও টিকছিল না। রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ শেষ জুড়ি ঘুমোতে চলে গেল, রয়ে গেলাম তথা আর আমি। ফাঁকা কমন রুম, টেবিল টেনিস বোর্ডের মাথার ওপর টিমটিম করে জ্বলা আলো, আলো-আঁধারী তার মাঝে চুটিয়ে শুরু হলো দুই আনাড়ির টেবিল টেনিস প্র্যাকটিস।
ঠকাঠক ঠকাঠক। ব্যাট আর বলের আওয়াজ প্রথমে কানে না আসলেও খানিকক্ষণ পর শব্দটা একঘেয়ে বিরক্তিকর লাগতে শুরু করলো। অনেকে বলে টেবিল টেনিস খেলাটা সবচেয়ে কঠিন, রিফ্লেক্স খুব ধারালো না হলে এ খেলা রপ্ত করা কঠিন। কিছুক্ষণ খেলার পর সেটা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করলাম। হাত পা শরীরচর্চার অভাবে ঝনঝন করছে, তবু জেদের বশে চলতে থাকলো রেলি। ঘড়ির কাঁটাগুলো একবগ্গা ঘুরে ঘুরে সময় বয়ান করতে লাগলো একটা দেড়টা দুটো, আমাদের খেলার উৎসাহে ক্ষান্তি পড়লনা তবুও। নিশিগ্রস্ত মানুষদের মত আমি আর তথা চালিয়ে যেতে লাগলাম সার্ভ স্লাইস স্ম্যাশ। আমি খেলছিলাম কমন রুমের পেছনের দেয়ালের দিক থেকে, আর তথা ছিল দরজার দিকে। আমি যতবার জিতছিলাম রেলিতে বলটা গড়িয়ে গড়িয়ে কমন রুমের বাইরে চলে যাচ্ছিল তাই দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আবার শুরু হলো প্র্যাকটিস।
আমাদের একঘেয়েমি ভাঙলো তথা সার্ভ করতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ানোয়। ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে ও আমার পেছনের দেয়ালের দিকে কিছু একটা দেখছে। একে এত রাত তার ওপর সময় নষ্ট, জিজ্ঞাসা করলাম
– কিরে সার্ভ করছিসনা কেন? থামলি কি কারণে?
চোখ না সরিয়ে তথা উত্তর দিল
– মনে হলো কিছু একটা যেন নড়ছিল ঐ দরজাটার দিকে।
তথার আঙ্গুল নিউজ রুমের দরজার দিকে নির্দেশ করছে।
– ধুর ওখানে আবার কি নড়বে। পোকামাকড় হবে।
– তাই হবে। হয়ত ল্যাম্পের আলোটা কোথাও রিফ্লেক্ট করে চোখে পড়েছে।
আবার শুরু করলাম খেলা কিন্তু ঠিক করলাম যে তিনটে গেম খেলব কে জিতবে ঠিক করার জন্যে, তারপর রুমে ফিরে যাব।
প্রথম গেমের মাঝপথে তথা একটা স্ম্যাশ মারলো, সেটা ফেরাতে পারলামনা, বলটা গড়িয়ে চলে গেল কমন রুমের পেছন দিকে, টিভি আর নিউজ রুমের কোনটায়। বল কুড়িয়ে ফিরে আসছি হঠাৎ চোখ তুলে তথার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। ও আবার আমার পেছনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে, চোখ বিস্ফারিত খানিকটা বিস্ময় খানিকটা আতঙ্ক জুড়ে ওর মুখে চোখে। ছোটবেলা থেকে গাদা গুচ্ছের বই পড়ে পড়ে রজ্জুতে সর্পভ্রম আমার স্বভাব, তাই ছোটখাটো ঘটনাকেও মনে মনে তিলকে তাল করে ভয় পাওয়া আমার কাছে নতুন কিছু নয়। তবু সেই রাত্রে তথাকে ওভাবে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনটা ছ্যাঁত করে উঠলো আমার। যতই ঘাবড়ে যাইনা কেন, এই মুহূর্তগুলোতে অ্যাড্রিনালিন শরীরকে হঠাৎ সজাগ করে দেয়। সময় থমকে দাঁড়ায় সব ঘটনাবলী বিচার করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ানোর জন্যে। মাথা তখন লজিক খুঁজতে শুরু করে, অলীক কান্ডকারখানায় তার তখন কোনো আগ্রহ নেই। সেরকমই সেই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে তথার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
– কিরে আবার কি হলো?
– নিউজ রুমের তালাটা নড়ছিল।
– ধুর কি যা তা বলছিস। তালা আবার নড়বে কি করে? আলো রিফ্লেক্ট করেছে সেটাই দেখেছিস হয়ত।
ভেবেছিলাম তথা বলবে আমার পেছনে কেউ ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সেটা বললে প্রাণ খাঁচাছাড়া হয়ে যেত। ও যখন বলল তালা নড়ছে, মনে আবার স্বস্তি ফিরে পেলাম। তালা আবার কি নড়বে! খানিক বীরপুরুষের মত যাচাই করে দেখার জন্যে ফিরে গেলাম দরজার কাছে। নতুন স্টেনলেস স্টিলের তালা দরজার কড়া থেকে ঝুলছে। নড়াচড়ার কোনো চিহ্ন নেই। তবে হ্যাঁ টেবিল টেনিসের টেবিল থেকে এদিকটা দেখতে যেমন লাগছিল এখন দরজার সামনে আলো আঁধারীতে দাঁড়িয়ে চারপাশের অন্ধকারটা যেন একটু বেশিই গাঢ় মনে হচ্ছে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার কোনো ইচ্ছেই নেই ওই ভুতুড়ে ছায়া আবছায়া ঘেরা কোনে, তাই তথাকে হেঁকে বললাম
– দেখ তালা যে কে সেই কিচ্ছু নড়ছেনা এখানে। ভুল দেখেছিস। চল এই গেমটা শেষ করে শুতে যাই, অনেক রাত হলো।
তথাও দেখলাম নিশ্চিন্ত যে চাক্ষুষ যাচাই করে নিয়েছি আমরা তালা নড়ছেনা।
ফেরার জন্যে সবে দুই পা বাড়িয়েছি হঠাৎ তথা বেশ জোরে অথচ আতঙ্কগ্রস্ত চাপা গলায় বলে উঠলো
– হনু ওই আবার নড়ছে।
এত চেষ্টা চরিত্র করে মনটাকে যে শান্ত করেছিলাম সেটা আবার নিমেষে উধাও হয়ে গেল। যেন ছুরিওলা আততায়ী আবার আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। গায়ের তো সব লোম খাড়া হয়ে গেছে ঘামে ভেজা হওয়া সত্ত্বেও। নাড়ি দৌড়চ্ছে উর্ধশ্বাসে, তবু কোনমতে মনে জোর এনে আবার বললাম
– নড়ছে মানে? ইয়ার্কি মারছিস না তো এত রাতে?
– মাকালীর দিব্যি। ওই দেখ আবার নড়ছে তালাটা সরে আয় তাড়াতাড়ি।
এটা শুনেই হাড় হিম হয়ে গেল আমার। কমন রুমে খালি আমি আর তথা দুজনেই পনের বিশ ফুট দুরে যখন তথা প্রথম বার দেখতে পেয়েছিল। তালাটা যদি নিজে নিজে নড়ে তাহলে সেটা যে ভৌতিক কান্ড তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তা সত্ত্বেও পালাবার আগে একবার দেখে নেয়ার উৎকন্ঠা সামলাতে পারলামনা। পেছন ঘুরে দাঁড়ালাম নিউজ রুমের দরজার সামনে। তালা আবার আগের মত ঝুলছে, নড়ার কোনো চিহ্নই নেই। বামুনকে খিস্তি মারব বলে ঘুরতে যাচ্ছি ঠিক সেই সময় চোখের সামনে যা ঘটল তার বর্ণনা এখনো পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে রয়েছে। তালার থেকে আমার চোখ হয়ত পাঁচ ফুট হবে মেরেকেটে, অত কাছ থেকে ভুল দেখা সম্ভব নয়। তালাটা যেন হঠাৎ কোনো জাদুমন্ত্রে প্রাণ ফিরে পেল। প্রথমে একটু নড়ে উঠলো, তারপর তলার হুকের দিকটা কড়ার মধ্যে থাকলেও তাকে কেন্দ্র করে তালার মেন বডিটা ঘুরে উপরের দিকে উঠতে লাগলো – প্রথমে আসতে আসতে, তারপর বেশ তাড়াতাড়িই। তালা যখন থামল তার যাত্রা শেষ করে, চাবির দিকটা আমার চোখের সামনে। চাক্ষুষ একটা তালা ঘুরে নিচের দিকটা উপরে হয়ে দাঁড়িয়ে, নিউটন সাহেবের মাধ্যাকর্ষণ নস্যাৎ করে।
আমাদের জীবনে এরকম অনেক মুহূর্ত আসে যেগুলো কখনো চেষ্টা করেও ভোলা যায়না। ৯৭য়ের সেই রাত্রির সেই মুহুর্তটাও সেরকমই এক ক্ষণ যখন নিজের অস্তিত্বকে মনে হয় অবান্তর, মনে হয় এতদিন যা শিখে, জেনে, বিশ্বাস করে এসেছি এক লহমায় তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তাত্ত্বিক যৌক্তিক সত্ত্বাটাকে জলাঞ্জলি দিয়ে মনে ঢুকে আসে ভয়। ঠিক সেই সময়টাতে ভয়কে যেমন ভাবে প্রত্যক্ষ করেছি, সেরকম জীবনে এখনো অবধি আর কখনো হয়নি। ভয় এসে যেন সারা শরীরটাকে বিকল করে দিয়ে গেল। রূপকথার জাদুর ছোঁয়ায় বা মেডুসার চোখের চাহনিতে মানুষ যেমন পাথর হয়ে যায়, সেরকমই যেন পা দুটোকে কেউ ফেভিকল দিয়ে মেঝেতে এঁটে দিয়ে গেছে। সম্মোহিতের মত তাকিয়ে রইলাম ছায়া আবছায়া ঘেরা টিমটিমে আলো পড়া তালাটার দিকে, যেন সেটার ওপরই নির্ভর করছে আমাদের ভাগ্য, তালা খুলে গেলে দরজার ওপারের প্রেত জগৎ গ্রাস করে নেবে আমাদের।
– হনু পালা। ওই ঘরে ভূত আছে।
সম্বিত ফিরে এলো তথার গলায়। ও কথা শেষ করার আগেই আমি আদ্ধেক রাস্তা পেরিয়ে এসেছি। ব্যাটগুলো ছুঁড়ে ফেললাম বোর্ডের ওপর কিন্তু কড়া নিয়ম সব আলো নিভিয়ে কমন রুমের দরজা লক করে তবেই যাওয়া যাবে। কতক্ষণ লেগেছিল সেগুলো সারতে মনে নেই, খালি মনে হচ্ছিল প্রতিটা সেকেন্ড দেরী করছি তালা লাগাতে, ওপারের থেকে আমাদের দুরত্বটাও কমে আসছে বেশ খানিকটা করে। কমন রুমের বাইরে আলো একটু রয়েছে সিঁড়ির কাছে সেখানে সব ছাত্রদের সাইকেল রাখা। দৌড়তে গিয়ে দুমদাম পড়ল দু চারটে সাইকেল, তখন আমাদের দাঁড়িয়ে সেগুলো খাড়া করার সময় নেই। সিঁড়ি থেকে অন্ধকার করিডোর দিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে ঘরে ফিরে দরজাটাকে যত ভাবে সম্ভব এঁটে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছু শুনতে পাওয়া যায় কিনা দেখতে। বুক তখন ধড়ফড় করছে, ওপারের জগতের থেকে কয়েক গজ দুরে ছিলাম সেটা ভেবেই হাড় হিম হয়ে রয়েছে তখন, চোখের সামনে রিপ্লে দেখতে পাচ্ছি তালাটার চলাফেরা। তবু মন জানতে চাইছে ঠিক কি ছিল দরজার পেছনে। নিউজ রুমে কি কেউ কখনো আত্মহত্যা করেছিল? নাকি এরা চা বাগান আর করলার দিকে ধানক্ষেতে গুমখুন হওয়া আত্মা, চাঁদনি রাতে চা বাগানে ভেসে বেড়ানো প্রেতকুল? রুমে ফিরে আমি আর তথা অনেক বিচার করে দেখলাম যে আমাদের বিভ্রান্তি বিন্দুমাত্রও কাটেনি বরং বেড়েছে। তবে আর একটা ব্যাপারও মনে হলো তখন। পরদিন লোকজনকে বললে যে তারা আমাদের প্রচুর খোরাক দেবে তা তখনি পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল, আমাদের রক্ত জল করা অভিজ্ঞতা যে আর কেউ বিশ্বাস করবে তা একবারের জন্যও মনে হয়নি। সে হোক বা, আমরা এটুকুই ভাবতে পারছিলাম তখন যে আমরা দুজনেই একটা ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি যার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা আমাদের নেই। কি ছিল সেটা জানতে না পারলেও এই ঘটনাটা মনের মধ্যে গেঁথে গেল চিরদিনের জন্যে। তালা ভুতের সেই ঘটনা আমার জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর মধ্যে একটা। চোখ বুজলে এখনও দেখতে পাই সেই আবছায়া ঘেরা কমন রুম, চেয়ার থাম এসবের ছায়ায় ঘেরা নিউজ রুমের দরজা, শুনশান রাতের নিস্তব্ধতা আর এসবের মাঝে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা তালা – অধিভৌতিকের চরম অভিজ্ঞতা। মন তবু প্রশ্ন করে সেই রাত্রে ওই দরজার পেছনে কি ছিল? খেদ রয়েই গেল যে সেটা জানতে পারলাম না। যদি পারতাম তবে কি আজ আমি থাকতাম? কে জানে।
পরিশেষ: কি ছিল দরজার পেছনে সেই রহস্যের যবনিকা উঠলো পরদিন। যেমনটা আশা করেছিলাম ঠিক তাই। যতজনকে বললাম আমাদের অভিজ্ঞতার কথা সবাই অনেক ঠাট্টা করলো। এসব নাকি ছিল আমাদের কল্পনা আর গোঁড়া কুসংস্কার। দুপুরের দিকে একদল ফার্স্ট ইয়ার আমাদের টানতে টানতে নিয়ে গেল কমন রুমে। উদ্দেশ্য প্রমান করা যে আমরা ভুল দেখেছি। আমাদের যাবার কোনো প্রবৃত্তি ছিলনা তাই পেছনে দাঁড়িয়ে রইলাম, বাকিরা প্রবল উৎসাহে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জরিপ করতে লাগলো চারদিক। হঠাৎ সেই ভরদুপুরে আমাদের দু জোড়া নয় একগাদা চোখের সামনে তালা আবার ওপরের দিকে ঘোরা আরম্ভ করলো। অতিউৎসাহীর দলের সেই উচ্ছ্বাস নিমেষে মিলিয়ে গেল, সবাই যে যার মত দরজার দিকে দৌড়তে আরম্ভ করলো। দাঁড়িয়ে ছিল যতদুর মনে পড়ে বিক্রম আর ডিফেন্স। ওরা খানিক পিছু হঠে আবার গেল দরজার সামনে, আর তখনি বোঝা গেল আসল কারণ। ওরা দেখল যে নিউজ রুমের দরজাটা নড়ছে, আর যতবার দরজা পেছনের দিকে সরছে তালাটা ওপরের দিকে ওঠার চেচ্টা করছে ঠেলা মেরে। এতক্ষণে বোঝা গেল দায়ী টা কে। সেটা ছিল ডুয়ার্স থেকে ভেসে আসা বাতাস – নিউজ রুমের খড়খড়ি পেরিয়ে ওই হাওয়া ঠেলা মারছিল দরজায় আর দরজার কড়া তালাকে ঠেলছিল খাড়া হবার চেষ্টায়। রহস্য সমাধান হয়ে গেল, অতি সাহসীরা আবার ফিরে এলো, পিঠ চাপড়ানো হলো সবার, আমি আর তথা হয়ে গেলাম আবার খোরাকের টার্গেট যেহেতু আমরা দুয়ে দুয়ে চার করতে পারিনি। সত্যি আর কল্পনার জগতের তফাতটা রাতের দিকে অনেক বেশি অস্পষ্ট, দিনের বেলা যা পরিষ্কার ভাবে দেখা যায়, রাতের বেলা আলো আঁধারীতে তাকেই মনে হয় ভৌতিক। মনে কিন্তু খটকাটা রয়েই গেল। সেই রাত্তিরে ওই দরজার পেছনে সত্যিই কি কেউ ছিল? উত্তরটা মনে হয় লুকিয়ে আছে আমাদের মনের ভেতর। কেউ ছিল সে রাত্রে যদি আমরা মনে করি কেউ ছিল। যদি মনে করি ছিলনা, তাহলে সেটা শুধু হাওয়ার খেলা।