Friday, 3 April 2015

আধুনিক বাঙলায় লুপ্তপ্রায় কিছু দৈনন্দিন শব্দ

অনেকদিন আগে ফেসবুকে একটা পোস্ট লিখেছিলাম ঘুলঘুলি শব্দটা নিয়ে। মূল বিষয় ছিল বাংলা ভাষায় কীভাবে নতুন সব শব্দ ঢুকে পড়ে আবার সময়ের সাথে সাথে বহুলপ্রচলিত শব্দরা কেমন করে হারিয়ে যায়। এখানে তেমন কিছু শব্দ তুলে ধরলাম যেগুলো ছেলেবেলায় প্রচুর ব্যবহৃত হত কিন্তু এখন কেমন আর শোনাই যায় না। কলকাতায় এই বিলুপ্তির হার বাকী বাংলার চেয়ে বেশীই মনে হয় কারন মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা কলকাতায় স্বাভাবিক কারনেই অনেক দ্রুত আর বেশী মাত্রায় পরিবর্তন হয়েছে। আর গৌড়চন্দ্রিকা না করে দেখে নেয়া যাক শব্দের লিস্টটা:

ঘুলঘুলি : এককালে সব পাকা বাড়িতেই থাকত হাওয়া আসার জন্য। ঘরে পাখি আসত সেই ঘুলঘুলিতে বাসা বাঁধার জন্য খড়কুটো নিয়ে। এখন শহর বা গ্রামে বেশির ভাগ বাড়িই পাকা কিন্তু দালান বাড়ি নয় তাই জানলাতেই কাজ চলে যায়। ফ্ল্যাটেও তাই। পুরনো বাড়িঘর বাদে ঘুলঘুলিও তাই বিলুপ্তির পথে, সেই সাথে শব্দের পরিচয়ও। 

হ্যাজাক : এই কথাটা কোথা থেকে বাংলায় এল ভেবে বার করতে পারলামনা কিন্তু প্রতিশব্দ হল পেট্রোম্যাক্স। যখন বেশির ভাগ গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি আর শহরে সেটা থাকলেও আদ্ধেক সন্ধ্যাবেলা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং চলত, সাধারন ঘরে ব্যবহৃত হত হ্যারিকেন, কিন্তু অবস্থাপন্ন বাড়িতে জ্বলত হ্যাজাক। আর চলত মুদির দোকানে। মাঝেমধ্যে ম্যান্টেল ফাটার জন্যে লোকে বাড়িতে ব্যবহারের সাহস দেখাতে পারতো না বটে, আর পুরো আলোর জন্য পাম্প দিতে অনেকক্ষণ লাগতো, কিন্তু হ্যাজাকের আলো যখন পুরো ছড়াত, ইলেকট্রিক বাতির আলো তার ধারেকাছেও লাগতো না। এখন গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে আর সাপ্লাইও অনেক ভাল, লোডশেডিং হয় কালেভদ্রে, তাই হ্যারিকেন হ্যাজাকের দরকারও ফুরিয়েছে, গুটিকয় মোমবাতি ঘরে রাখলেই নিশ্চিন্ত। হ্যাজাকের ব্যবহার হয়তো সীমিত প্রত্যন্ত গ্রামে ফসলের সময়, তাই শব্দের সাথে সাথে তার আকৃতি, ব্যবহার এসবও হারিয়ে যাবে। 

কুলো : একটা কারনে কুলো এখনো খুব পপুলার সেটা হল বিয়ের তত্ত্ব সাজানোর। তাই কুলোর ব্যবহার যে এখনই লোপ পাবে তা হয়তো নয়। কিন্তু কুলোর আসল ব্যবহার যে দুরকম ঘনত্বের জিনিসকে আলাদা করা সেটা সম্ভবত চাষাবাদেই সীমিত। যখন ছোট ছিলাম অনেক কালোবাজারি ব্যবসায়ী ছিল চারদিকে, চাল ডালে কাঁকড় খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল, তাই কুলো ছিল অপরিহার্য এই কাঁকড় বাছার জন্য। এখন বেশীরভাগ ব্যবসায় চালায় পাইকারী ব্যবসায়ীরা, আর লোকেও বেশী পয়সা দিতে প্রস্তুত খাঁটি জিনিসের জন্য। কুলোর সেই ঝাড়াইবাছাই ব্যবহার তাই এখন অচল। 

ঘুঁটে : মনে আছে কলেজে পড়তে যাবার দ্বিতীয় দিন সবাইকে ঘুঁটে দিতে হয়েছিল হোস্টেলের দেয়ালে। বাড়িতে বহুদিন কয়লার উনুনের চল ছিল তাই সেই উনুন ধরাতে ঘুঁটে ছিল আবশ্যিক। কয়লার বাক্সের পাশে থাকত ঘুঁটের বাক্স। গ্রামের মাটির চুল্লিতেও একই রকম পদ্ধতি। এখন লোকে হয় এলপিজি নয় কেরোসিন স্টোভ ব্যবহার করে, এতে জ্বালানিরও সাশ্রয় হয় আর ইচ্ছেমত জ্বালান নেভান যায়। কয়লার উনুন আর সেইসাথে ঘুঁটের চলও এখন নেই বললেই চলে। গ্রামে গরীব ঘরে হয়তো এখনো চলে ঘুঁটে কিন্তু কতদিন চলবে কে জানে। 

খোল : না বালিশের খোল নয়, আর খোল কর্ত্তালের খোলও না, এটা হল সর্ষের খোল। কলুর বলদ দেখেছি এক দুবার কিন্তু এমনিতে ঘানিগুলো চালায় লোকে ইলেকট্রিকে নয় হাতে চালানো মেশিনে। ঘানিতে সর্ষের তেল পিষে নেবার পর বাকী সর্ষের খোসা আর শস্যের যে বাদামী চাকলা গুলো পড়ে সেই খোল। ঘানির থেকে নামমাত্র পয়সায় কিনে সেই খোল জলে ভিজিয়ে রাখার পরদিন যে অখাদ্য দুর্গন্ধের মিশ্রণ তৈরী হয় বিকল্প সার হিসাবে বাড়ির বাগানের ফুলফলের জন্য যথেষ্ট। আজকাল সেই স্বাবলম্বী ঘানি তেমন নেই বিশেষ করে শহরে, প্রতিযোগীতার যুগে ধারা, ইঞ্জিনের সাথে তাল মেলাতে না পেরে এরা বিকল্প ব্যবসার সন্ধানে তেমনি প্রসেস করা পদ্ধতিতে খোলের পরিমান কম আর সেটা যে কোথায় যায় জানা নেই। যদি এখনো না হয়ে থাকে, মনে হয় অন্তত শহরাঞ্চলে সর্ষের খোল কথাটার তাৎপর্য কেমন থাকবেনা ভবিষ্যতে। 

মুটে : মুটে আর কুলির মধ্যে তফাত মনে হয় মুটেরা হল কুলীন, কুলিরা যেকোন ধরনের ভার বায় যেখানে মুটে সাধারণত বয় বাজারপত্র। মুটেদের সথে থাকতো এক বড় ঝাঁকা মাল বওয়ার জন্য। বড় মুদির দোকানের বাঁধা খদ্দেরদের জন্য মুটে থাকত বাজার বাড়ি পৌঁছে দেবার জন্য। আগে বাজার হতো মুলত মাসকাবারি তাই মুটের ঝাঁকা ভর্তিই হয়ে যেত। এখন মাসকাবারি বাজার প্রায় উঠেই গেছে তাই ঝাঁকামুটে মাইনে দিয়ে রাখাও দোকানগুলোর পক্ষে তেমন লাভজনক রইল না। তারা হয় এখন বেছে নিয়েছে অন্য জীবিকা না হয় কৌলিন্য বিসর্জন দিয়ে কুলিগিরি করছে।

দালান : দালানের উল্লেখ সাহিত্যে অনেক আছে কিন্তু এখনকার দিনে খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। গ্রামে আগে বাড়ি বলতে কাঁচাবাড়ি অর্থাৎ মাটির বাড়ি আর পাকাবাড়ি মানে ইঁট বালি সিমেন্টের বাড়ি। সংজ্ঞা বলতে গেলে যে পাকাবাড়ি গুলো আকারে বেশ বড় আর অন্তত একটা ধারের পুরোটা না হলেও অনেকটাই জুড়ে আছে লম্বা বারান্দা আর কলাম, সেটাই দালান বাড়ির বৈশিষ্ট্য আমার মনে হয়, এটা ঠিক না ভুল জানা নেই। সেই অর্থে কেউ চারতলা বাড়ি বানালেও সেটা যে দালান বাড়ি তার কোন কারন নেই। আজকের বাজারে জমির দাম যেখানে আগুন শহরে কী গ্রামে, মানুষ দালানবাড়ি বানানোর কথা মনে হয় স্বপ্নেও ভাবেনা। একটু বেশী জমি থাকলে সেটা প্রোমোটারদের দিয়ে বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি বানিয়ে নিজে গোটাকয় ফ্ল্যাট নেয়া এটাই চল। দালান জানতে হলে হয় পুরনো জমিদারবাড়ি অথবা গ্রামের দিকে এককালে বর্ধিষ্ণু-বর্তমানে শহর/বিদেশবাসী কিন্তু পুজোয় ফেরা পরিবারগুলোর আদি বসতবাড়ি, এই দুইই ভরসা। 

ভর : পদার্থবিজ্ঞানে ভর হল কোন বস্তুর মৌলিক ধর্ম। সেই ভরের কথা হচ্ছেনা, এটা হল সেই প্রথা যেখানে বিভিন্ন দেবদেবীর ভর হয় মানুষের ওপর। সাধারণত এয়ো স্ত্রীদের ওপরই ভর করে, তাকে ঘিরে বাকী মহিলারা তারস্বরে উলুধ্বনি দেয় আর ভর হওয়া মহিলা তার খোলা চুলসহ মাথা সজোরে নাড়াতে থাকে। ভর হবার পর কী হয় তার সঠিক বিবরন মনে পড়ছেনা, খুব সম্ভব বাকী লোকে লাইন দিয়ে তাদের আশা ইচ্ছা পেশ করে। ভরের চল হয়তো এখনও আছে কিন্তু সংখ্যা অনেক কম, গ্রামেগঞ্জে সীমিত। 

(চলবে)


Musings on Durgapuja 2013

Taken from another Facebook post in 2013:


A day and an hour later, I did finally manage to wake up, 5am, and put the YouTube on, just as it used to be Kolkata ko on radio before, to the mahishasuramardini. Before, it used to be a wholesome experience, the mesmerising baritone of Birendrakrishna Bhadra and the anticipation of the forthcoming five days that I had had been waiting since the previous dashami; but now listening to the programme fills my mind with a myriad of thoughts and memories, 90 minutes of soul searching. It brings me to the early days of childhood where the only gadget we had in the house was one radio, and dearly missed baba, who I had the share the radio with every Mahalaya, and who'd wake me up just when it was to start. Listening to the reverberating chants in the early hours of the morning also made me think how - despite having my only religious allegiance to late Mr Marx(still!), and being strictly atheist - the next ten days will smudge the border line between religion and atheism. Although my hands would never raise to a pronam, I would still be at the anjali, have choronamrito and shantir jol, put on a tika after shondhi pujo and shidur after debi boron. For me it bears more significance to the fact that it is a time to reunite with all the people -friends and family- whose paths have diverged but those five days of puja they all come together, it's the time to share all gossip, go silly, stay up all night, eat out -a time to relive the past, or an attempt to turn the time backwards, and none of this calls for a religious piety of the earthen idol. Durgapuja is a part of my Bengali existence as much as Rabindra, Satyajit, Shirshendu, Sunil or East Bengal or Uttam, Soumitra or Anandabajar. Mahalaya is a bittersweet reminder that pujo is there outside my door, just five days and just 5000 miles away. But I'm glad pujo is here, I can close my eyes and would still feel the beats of dhak, smells of jogno and bhog and would think the words of another great man "Of course it is happening inside your head, Harry, but why on earth should that mean that it is not real?"

A Review on Wer, Wenn nicht Wir and a parallel into revolutionary socialism in 70s

Recreated from a Facebook post in February 2013

Yesterday watched a film, "Wer, wenn nicht wir"(who, if not us) that focussed on the earlier years of the Baader-Meinhof gang. Looking up on the net about their uprising and the end, it reminds me of a very similar movement much closer at home, the naxalite movement and specially of a book by Subhas Basu "Gol Ruti, Neel Chand" (Round bread and blue moon) that depicted how the fraction distanced themselves from the Communist party and right up to their disillusionment and dissolution. Just branding similar movements as terrorist activities, as some sites do, will be a gross simplification and misrepresentation of the world history of the time. One cannot condone the violence they started, and replace the losses the families suffered, but these are the tales of a lost youth, utterly brilliant and motivated - they were philosophers, writers, artists, journalists - yet lost in the tumultuous period the world was going through, and were fighting an enemy they couldn't have overthrown, for it didn't really exist. Forty years on since Vietnam, the youth movement calmed down a lot, the only violence you see is either by right-wing fundamentalists or state-sanctioned "peace-keeping missions" (or domestic); the terms Fascist and Capitalist aren't synonymous any more as aren't Socialist and Left-wing. Perhaps we are converging towards a de-polarised world that will see a harmonious coexistence of both theories, and will benefit all strata of people. Making it happen within a country - quite possible. Making it happen worldwide - Not!

ভুত ও ভবিষ্যৎ: বাঙলা সংস্কৃতিতে ভুতের প্রকারভেদ

কয়েক দশক আগেও বেড়ে ওঠার সময়ে বিভিন্ন গল্পগাথার মধ্যে ভুতের প্রভাব ছিল অনেকটাই। "ভুত আমার পুত পেত্নী আমার ঝি রাম লক্ষ্মন বুকে আছে ভয়টা আমার কী" এই জাতীয় ছড়া বা অন্ধকার রাস্তায় রাম রাম বলা জাতীয় আচার ছিল বহু প্রচলিত। অনেকে এখন ছেলেমেয়েদের আবেগতাড়িত হয়ে বাংলা শিশুসাহিত্য পড়ায় বটে কিন্তু মনে হয়না সেটা স্বতঃস্ফুর্ত। ইংরেজী পাঠ্যক্রম আর টিভি/সিনেমার দৌলতে অনেক বিদেশী ভুতের নামই জানা যায় কিন্তু ভুত আর পেত্নী বাদ দিয়ে বাংলায় আরো যে সুনির্দিষ্ট ভুতের নাম আছে সেগুলো শিশুসাহিত্যের পাঠ কমার সাথে সাথে কমেছে। সবগুলো আমারও জানা নেই তবে চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক কিছু নামে যেগুলো মনে পড়ছে-

ব্রহ্মদৈত্য-ভুতেদের জিউস বা পালের গোদা, বামুন মরে ভুত হলে ইনি জন্মান। যে গাছে ব্রহ্মদৈত্য থাকে খুব সম্ভব সে গাছে অন্য ভুত থাকেনা। এরা সাধারণত খুব একটা ক্ষতি করেনা, বরং অন্য ভুতদের কন্ট্রোল করে। 

আলেয়া-জলাজমিতে মিথেন গ্যাস এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। জ্বলতে নিভতে থাকা আলো। সাধারণত রাতে পথিককে আল থেকে আলে ঘুরিয়ে মারা এর উদ্দেশ্য। সব ভৌতিক ঘটনার মধ্যে আলেয়াই একমাত্র দেখা যায় আর তার একটা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা আছে। 

কানাওলা/কানাভুলো-মনে হয় আলেয়ার প্রকারভেদ। তবে কানাওলা নেহাতই ভুত, আলেয়ার মত অন্য কোন রূপে প্রকাশ পায় না। সাধারণত পথিকদের ওপর ভর করলে তারা দিক ভুলে যায় আর একই পথে চক্কর খেতে খেতে কাহিল হয়ে গেলে তখন তাকে নির্জন মাঠেঘাটে নিয়ে গিয়ে ফেলে। কানাওলায় পাওয়া মানুষ যদিও পরদিন ফিরে আসে যদি না রাস্তা হারিয়ে জলে ডোবে। 

নিশি-ছোটবেলায় নিশি শুনলেই ভয়ে লোম খাড়া হয়ে যেত, লিখতে বসে এখনও হচ্ছে। নিশি রাতে চেনা লোকের গলায় ঘুমন্ত মানুষকে ডাকে। সাড়া দিলেই সে নিশির কবলে পড়ে গেল, তাকে আর কেউ কখনো দেখতে পায় না। তিনবার ডাকলে তখন নিশ্চিন্ত হওয়া যায় সেটা নিশি না। 

শাঁকচুন্নী-এদের গলা খুব খোনা হয়, মহিলা ভুত সধবা অবস্থায় মারা গেলে অন্য মহিলাদের ওপর ভর করে। খুব সম্ভব শ্যাওড়া গাছে থাকে। 

কবন্ধ-খুব সম্ভব স্কন্ধকাটার আর এক নাম। 

স্কন্ধকাটা-মাথা কাটা গিয়ে ভুত হলে তারা স্কন্ধকাটা হয়। এরা লোককে তাদের মাথা খুঁজে দেবার জন্য ধরে। 

মামদো-এরা যে কি ধরনের ভুত তার কোন ধারনা নেই। কোথাও পড়েছিলাম মামদোর ছানারা বেশ মিস্টি হয়। মামদোরা তেমন ক্ষতিকর ভুত নয়, ফালতু ঝামেলা করাই এদের মূল উদ্দেশ্য অনেকটা পল্টারগাইস্টদের মতন। 

মেছোভুত-মনে হয় সবচেয়ে নিরীহ আর ছাপোষা ভুত এরাই। পুকুর জলার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে আর লোক দেখলে তাদের মাছ ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। 

পেঁচো-এর সম্বন্ধেও প্রায় কিছুই জানা নেই। পেঁচোয় ধরলে বোধহয় লোকে মৃগীরুগীর মত ছটফট করে। 

পেত্নী-সব মেয়ে ভুত যে পেত্নী তা নয়। পেত্নী মাত্রই তবে মেয়েদের ভুত। এরা সাধারণত মেয়েদের রূপ ধারণ করে থাকে শেষ মুহূর্ত অবধি। মানুষদের ঘাড় মটকে মেরে ফেলাই এদের লক্ষ্য। পেত্নীদের পা উল্টোদিকে ঘোরানো থাকে যা দেখে এদের চেনা যায়, আর সেইজন্য তারা শাড়ী দিয়ে পায়ের পাতা ঢেকে রাখে। 

এই শব্দগুলো ছাড়াও লোকসাহিতে্য অন্যান্য নামের ভুতের উল্লেখ পাওয়া যাবে বিশেষ করে বিভিন্ন আঞ্চলিক শব্দ যা শুধু সেই এলাকায় চলে যেমন বেঘো ভুত সুন্দরবনে। অনেক ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক নামগুলো একই ধরণের ভুতের বিকৃতি। 

ভুত আছে কি নেই সেটা একটা বড় প্রশ্ন যেখানে জড়িয়ে আছে বিশ্বাস আর অবিশ্বাস। আমি অবিশ্বাসী আর সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একমাত্র আলেয়ার অস্তিত্ব প্রমাণিত আর তার বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষন আছে। বাকী বেশীরভাগই মানুষের কল্পনা ভয় আর রাতের আলো আঁধারির যোগফল। আর কিছুটা অন্যান্য লোকের ছড়ানো গল্প যার পেছনে কোন মতলব থাকে। আজকের দিনে যেখানে জলা পুকুর সব বোজানো হচ্ছে আর জঙ্গল সাফ হয়ে যাচ্ছে সেখানে এইসব আলো আঁধারির আর তেমন মানুষের মনের সাথে ছলচাতুরি করার জায়গা নেই বিশেষ করে যখন রাস্তায় রাস্তায় আলোর ছড়াছড়ি। ভুতেরাও সেইজন্য বোধহয় পালিয়ে চলেছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। ভুত না থাকলেও তবু ভয়টা কিছুটা রয়েই যায় যেটা প্রকাশ পায় অন্ধকার রাস্তায় চলার সময় বা রাতে নির্জন শ্মশানে গোরস্থানে তবে সেটা ভুতের না হঠাৎ অজানা কোন কিছুর সামনে পড়ার সেটা বলা মুস্কিল। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা যুক্তি দিয়ে এই ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষন করে প্রমান করি যে আপাতভাবে যে ঘটনাগুলো ভৌতিক মনে হয় তার পেছনে একটা ব্যাখ্যা আছে। তবে স্থান-কাল-পাত্র নিরীখে অনেক সময় যুক্তি ব্যবহার করা যায়না, যেখান থেকে ভুতের ব্যুৎপত্তি, যেভাবে প্রাচীনকালে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ভগবানের হস্তক্ষেপ বলে মনে করা হতো। 

ভুতের ভবিষ্যৎ কী সেটা অনেকটা নির্ভর করবে আগামী দিনে লেখক আর পাঠকদের ওপর। বিংশ শতকের সাহিত্যে ভুতের অনেক উল্লেখ পাওয়া যাবে কিন্তু নতুন পাঠকরা যদি সেই লেখার সাথে পরিচিত না হয় তবে ভুতেরাও হারিয়ে যাবে এই লেখাগুলোর সাথে সাথে। আর সেখানে নতুন লেখকদের প্রসঙ্গ আসছে, তাদের লেখায় এই বিগত শতকের লেখার কতটা প্রভাব থাকবে তার ওপর নির্ভর করবে আগেকার ভুতের প্রকারগুলো বজায় থাকবে না পাল্টে যাবে আধুনিক জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে, যেমন সাম্প্রদায়িক ভুত, টেররিস্ট ভুত ইত্যাদিতে। তবে বলাই বাহুল্য যে এই বিভিন্ন ধরনের ভুত যা বাঙালি জীবন আর সাহিত্যে বিরাজ করেছিল, সেটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে, শুধু থাকবে হয়তো একটা কমন শব্দ ভুত বা পেত্নী। 

Sunday, 29 March 2015

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট: এক ঝরা সময়ের ছবি

ছোটবেলার কথা মনে পড়লে খেলাধুলোর কথা যখন ভাবি প্রথমে ফুটবলের কথাই মনে আসে। আটের দশকে কলকাতা ফুটবলের রমরমা তখনো জারি। খবরের কাগজ, রেডিয়ো খুললেই ফুটবলের আলোচনা, রিলে ছাড়া কথা নেই। কৃশানু বিকাশ শিশির সুব্রত ছাড়াও নতুন আমদানি চিমা, তাছাড়া বারপুজো, দলবদল এসব নিয়েই বাজার গরম। ক্রিকেটের সাথে তখনো তেমন পরিচয় হয়নি, যদিও ভারত ততদিনে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে। কখনো সখনও ব্যাটবল খেলা (জানতাম না সেটাকেই ক্রিকেট বলে) আর গাভাসকর কপিলদেব অমরনাথ এইকটা নাম, এগুলোই ছিল ক্রিকেটজ্ঞান। এছাড়া ইডেনে খেলা পড়লে কলকাতা ক'য়ে রিলে "রান হয়ে গেছে নয় নয় করে…" বা "বল পাঠিয়ে দিলেন পত্রপাঠ সীমানার বাইরে" বাক্যগুলো প্রায় মুখস্ত হয়ে গেছে। তবে আর একটা ব্যাপার জানতাম যা ছাড়া তখন ক্রিকেট ভাবা যেতো না সেটা হল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। 


এখন মনস্তাত্বিকরা মনে করে যে আমাদের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ভাল লাগার পেছনে জুড়ে আছে ঔপনিবেশিক সত্তা, সাদা চামড়ার দেশগুলোর ওপর ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কালো মানুষদের একচ্ছত্র আধিপত্য দেখে নিজেদের ঔপনিবেশিক বঞ্চনার পরোক্ষ বদলা মনে করা। আমার ঐ বয়সে অত গুরুগম্ভীর ভাবনাচিন্তা করার বিষয় সেটা ছিলনা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের তখনকার লাইনআপ আর ফর্ম দেখেই মনে সম্ভ্রম জাগা স্বাভাবিক। ইনিংস শুরু করছে গর্ডন গ্রিনিজ আর ডেসমন্ড হেনস, ওপেনিং জুটিতে যাদের রেকর্ড অবসরের বহুদিন পরেও অটুট ছিল। তারপরে চার নম্বরে আইজ্যাক ভিভিয়ান আলেকজান্ডার রিচার্ডস, চুয়িং দাম চিবুতে চিবুতে একমুখ হাসি নিয়ে বিপক্ষের বোলিংকে তছনছ করে দিতে খুব কম ব্যাটসম্যানই পেরেছে সমগ্র ক্রিকেটের ইতিহাসে। ছিল গাস লোগির মত জাঁদরেল ফিল্ডার আর সবার ওপরে ছিল এক খতরনাক পেস ব্যাটারী, অ্যামব্রোস, মার্শাল, ওয়ালশ যারা গার্নার, হোল্ডিংয়ের বিখ্যাত (বা কুখ্যাত) ক্যারিবিয়ান ফাস্ট বোলিংয়ের পরম্পরা সার্থকভাবেই বজায় রেখেছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা মানেই ছিল একটা কী হয় কী হয় ভাব, আজ কে অন্য টিমকে দুরমুশ করবে সেটা জানার অপেক্ষা। 

এই সময়ের ঠিক পর পরই ক্রিকেটের ক্ষমতার কেন্দ্রটা বদলানো শুরু হয়ে গেল। একদিকে আবির্ভাব হল ক্রিকেটের রাজপুত্র ব্রায়ান চার্লস লারার, অন্যদিকে সব বাঘা বাঘা খেলোয়াড়দের অবসরের সময় ঘনিয়ে এল, গ্রিনিজ, হেনস, রিচার্ডস, মার্শাল একে একে সবাই বিদায় নিল নব্বইয়ের দশকে। ক্যারিবিয়ান ক্যালিপ্সো ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায় বর্তাল তরুণ লারা, রিচি রিচার্ডসন, হুপার ওয়ালশদের হাতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখনো এক শক্তিশালী দল, লারা একাই বহু ম্যাচ জিতিয়ে গেছে, কিন্তু তারা সেই দুর্বার দল নয়, বরং অ্যালান বর্ডারের অসিরা উঠে এসেছে পয়লা নম্বরে যেই আধিপত্য চলবে স্টিভ ওয়া, রিকি পন্টিংয়ের হাত ঘুরে প্রায় বিশ বছর জুড়ে। 

ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার ক্ষমতা দখল ছাড়াও আরো বেশ কিছু ঘটনা সেই একই সময়কালে ঘটছিল যা শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজ না, গোটা বিশ্ব ক্রিকেটকেই চিরতরে বদলে দিয়েছিল। সত্তরের কেরী প্যাকার সিরিজ দিয়ে যে একদিনের ক্রিকেটের শুরু, নব্বইয়ের দশকে টেস্ট ক্রিকেটের থেকে মনোরঞ্জনের তালিকায় বিজয়ীর স্থানে চলে এসেছে সেই ওয়ান ডে। সমগ্র বিশ্বে সেই সময়ে যে সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটছিল যেমন সোভিয়েত জমানার পতন, দুই জার্মানির পুনর্যুক্তি, ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণ, এবং এই বদলগুলোর সাথে বিশ্ব অর্থনীতির প্রসার সাধারন মানুষের জীবনেও এক স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। ফলে পাঁচ দিন ধরে সারাদিন ক্রিকেট দেখা বা রিলে শোনার মত সময় আর ধৈর্য্য কোনটাই খেটে খাওয়া মানুষের ছিলনা, যেখানে একদিনের ক্রিকেটের মত স্বল্পস্থায়ী বিনোদন বর্তমান। ফলে আস্তে আস্তে যোগ হতে লাগল রঙিন পোশাক, দিন-রাতের ম্যাচ ইত্যাদি। ব্যবসায় একটা কথা খুব প্রচলিত যে ক্রেতাই ঈশ্বর, যা ক্রিকেটে হল দর্শক, তাই যে পরিবর্তনগুলো আসছিল সবই ক্রিকেটকে আরো জনপ্রিয় করে তোলার জন্য দর্শকদের কাছে। 

এই আমূল পরিবর্তনের সময়ে যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা উঠে এসেছে প্রথম সারিতে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেই সময়ে পিছলে যাচ্ছিল প্রধান থেকে সাধারন থেকে নিম্নমানের দলে। বদলে যাওয়া সময়ের সাথে নিজেদের বদলাবার জায়গায় খেলোয়াড় কর্মকর্তা সবাই জড়িয়ে পড়ল অন্তর্কলহে। যদিও জানতাম যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আসলে ক্যারিবিয়ান সাগরে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য দ্বীপরাষ্ট্রের এক যৌথ দল, এটা জানতাম না যে উত্তরে জামাইকা থেকে দক্ষিণে গায়ানা অবধি দ্বীপগুলোর বিস্তৃতি দু-তিন হাজার কিলোমিটার। ভৌগোলিক এই বিশাল ব্যবধান বিচার করলে এটাই পরম আশ্চর্যের যে বিগত চার-পাঁচ দশক ধরে বিশ্ব ক্রিকেটের আঙিনায় এদের আধিপত্যের কী ব্যাখ্যা? প্র্যাকটিস করত কীভাবে, টিম সিলেকশন হত কীভাবে? ক্যারিবিয়ান দেশগুলির অর্থনীতি তেমন সবল নয়, পর্যটন ছাড়া মূল আয় প্রধানত কৃষিকাজ, সেখানে ক্রিকেট টিম স্থাপন আর চালানো এই বিশাল কর্মকান্ডের দায় কীভাবে বিভিন্ন দেশগুলো ভাগাভাগি করে নিত সেটা ভাবলেই অবাক লাগে। এই পরিকাঠামো বিচার করলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে যে অন্তর্দ্বন্ধ দেখা দিয়েছিল নয়ের দশকে, সেটা একসময় দেখা দিতই, দলের ফর্ম পড়ে যাওয়া এই বিবাদকে শুধু চাগিয়ে দিয়েছিল। 

নয়ের দশকে যে অবক্ষয়ের শুরু, নতুন মিলেনিয়ামে সেই চিড় ফাটলের আকার নিল। এই সময়ের ওয়েস্ট ইন্ডিজ পরিনত হয়েছিল হাতে গোনা কিছু প্রতিভাবান খেলোয়াড় সমৃদ্ধ এক অতি সাধারন দলে। চন্দ্রপল, সারওয়ান, ক্রিস গেইল ছাড়াও ছিল পড়তি সময়ের লারা। একুশ শতকের প্রথম দশ বছরে নতুন আমদানি হল ২০-২০ ক্রিকেট আর ক্লাবভিত্তিক আন্তর্জাতিক খেলা যেমন T20 বিশ্বকাপ, আইপিএল, সুপার কাপ ইত্যাদি। টেস্ট ক্রিকেটের গরিমা হয়তো ক্ষুন্ন হয়নি কিন্তু সাধারন দর্শকদের কাছে এ ছিল আরো একটা সহজলভ্য বিনোদন, তিন ঘন্টায় খেল খতম, আর বেশীরভাগ খেলাই দিন-রাতের তাই কাজেও তেমন ফাঁকি পড়বেনা। এই সময়ের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট লক্ষ্য করলে দেখা যাবে খেলোয়াড়দের বিবাদ, একজন স্থায়ী ক্যাপ্টেনের খামতি, ক্রিকেট বোর্ডের খেলোয়াড়দের মাইনে দিতে অস্বীকার এবং তার ফলস্বরূপ বেশ কিছু প্লেয়ারদের ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে না খেলে ক্লাব দলের হয়ে খেলা। 

শেষের কারণটা ক্রিকেটের পক্ষে চরম দুর্ভাগ্যের। নতুন শতকে ক্রিকেটের এই দশা সমগ্র বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিম্বাবয়ে এই দেশগুলোর, যেখানে আর্থিক অনটন আর বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট। এই দশ বছরে আইসিসি পর্যবসিত হয়েছিল রেভিনিউ কামানোর ইঁদুরদৌড়ে সামিল এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে। অর্থের প্রয়োজন অনস্বীকার্য কিন্তু বোর্ড নিজেদের অস্তিত্বের মূল কারন যা হল বিশ্বজুড়ে ক্রিকেটের প্রসার এবং খেলার মান আর উৎকর্ষতা বাড়ানো- সেটা সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে কেবল উপার্জনের ওপর সব গুরুত্ব দিয়েছিল। সংস্থার দখল চলে গেল ক্রিকেটারদের থেকে ব্যবসায়ীদের হাতে। ফলে শুরু হয় বিস্তর কারচুপি, বিসিসিআই এর মত শক্তিশালী বোর্ডগুলোর নিজেদের সুবিধামত পেশী আস্ফালন, খেলার নিয়মকানুনের বদল যার উদ্দেশ্য খেলার মান বাড়ান নয় বরং আমানতকারী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলির বানিজ্যিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা। নব্বইয়ের সময়ে ওয়ান ডে খেলার রমরমা দেখে যারা কু গেয়েছিল যে আইসিসি ক্রিকেটকে বেসবলে পরিনত করার চেষ্টা করছে, আজকের ২০-২০ ক্রিকেটের বাড়তি দেখে হয় তাঁরা মুচকি হাসছেন নাহয় জিভের তলায় সরবিট্রেট রাখছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের নতুন শতকের এই সমীকরণে সফল হওয়া নিতান্তই অসম্ভব হয়ে পড়ল, বিশেষ করে যখন আয়োজক মাঠের আয়ের অধিকাংশই যাবে আইসিসির কোষে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলির মধ্যে একমাত্র জামাইকা ছাড়া অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আর কারওই তেমন নেই তাই ক্রিকেট বোর্ডগুলোর মধ্যে বিবাদ-মতানৈক্য এসবের মূলে যে টাকাপয়সা জড়িয়ে, তা সন্দেহের ঊর্দ্ধে। ক্রিকেটের উৎকর্ষ বৃদ্ধির যূপকাষ্ঠে বলি হল ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিম্বাবয়ে এই দলগুলো যাদের শুধু খেলায় অংশগ্রহন করতেই অশেষ প্রতিকুলতার মোকাবিলা করতে হয়। আজকের দিনে এরা নিছকই কোল্যাটেরাল ড্যামেজ। 

বিগত দশ বছরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের অধোগতির জন্য যে খেলোয়াড়দের দায়ী করা যায় তা নয়। হয়তো আশির দশকের বুক কাঁপানো ড্রিম টিম নয় কিন্তু এখনকার টিমে যে প্রতিভার ঘাটতি আছে তা নয়, যেটা অনুপস্থিত তা হল আত্মবিশ্বাস আর দলীয় সংহতি। তাছাড়া টিম এখন পুরোপুরি ক্রিস গেইল ভিত্তিক, গেইল ব্যর্থ তবু ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম সারির দলগুলোর সাথে জিতেছে সেই ঘটনা বিরল। একটা দলকে সঠিক পথে চালান করার জন্য শুধু পনের জনের একটা টিমই যথেষ্ট না আজকের দিনে। টিম ম্যানেজমেন্টও সমান গুরুত্বপূর্ণ ফিজিও কোচ থেকে শুরু করে অ্যানালিস্টরা পর্যন্ত, সেটা যদি বোর্ড সুষ্ঠুভাবে না চালাতে পারে তবে দলের সাফল্যে তার প্রভাব পড়বেই। 

এ তো গেল তত্বের কচকচি যা হয়তো উইকি ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে। কিন্তু তার বাইরে আমার একটা যুক্তি আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের আজকের দুর্দশার পেছনে, খুব বিজ্ঞানসম্মত নয় তবু বলার প্রয়োজন মনে করলাম। সমগ্র ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ হল খুশী মানুষের দেশ, এখানে হাওয়ায় ছড়িয়ে আছে ক্যালিপ্সো, সোকা, রেগে। পেটে টান থাকলেও এখানে ঘাটতি নেই সুর্যের আলোর, নেই সোনালী বালির সমুদ্রতটের। এই পরিবেশে ক্রিকেট খেলাটা ছিল স্বাভাবিক জীবনযাত্রার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এভাবেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেয়েছে সোবার্স, লয়েড, রিচার্ডস, লারাদের - এদের ক্রিকেট জুড়ে রয়েছে বাতাসে ভেসে বেড়ানো সেই ক্যালিপ্সোর ছন্দ। এই আবহাওয়ায় বড় হয়ে যখন খেলোয়াড়রা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দৃঢ় সত্যের সামনে দাঁড়ায় আর বাধ্য হয় তার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেবার, তার ফল হয় অত্যন্ত হতাশাজনক। মানুষ বদলে তৈরী হয় রোবোট, তার ভেতর থেকে সব ছন্দ যায় হারিয়ে। ঠিক যেমনটা হয়েছে ব্রাজিলের ফুটবলে, তারা এখন ইউরোপীয় ফুটবলের সিস্টেমের বশ, এদের মধ্যে সাম্বার কোন চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। আর ঠিক তেমনভাবেই হারিয়ে গেছে ক্যালিপ্সো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট থেকে, যদি টাকার পেছনেই ছুটতে হয় তবে তো আছেই বেসবল, বাস্কেটবল আমেরিকায় খেলার হাতছানি। সেখানে নেই সেই চোখ ধাঁধানো রোদ্দুর, সোনালী বীচ বা ঢেউয়ের গর্জন, রেগের ঢিমেতাল লয় বদলে যায় চিয়ারলিডারদের উদ্দাম টিনসেলের ঝলকানিতে, যেটা যদিও এখন জায়গা করে নিয়েছে ক্রিকেট মাঠেও।

তবে সময়ের সাথে বদলায় সব কিছুই, অতীতকে আঁকড়ে ধরে সামনে এগিয়ে চলা যায়না। ধ্রুপদী ক্রিকেটের স্থান এক সময় মানুষের কাছে ছিল, আজ সেটা বিরল। পৃথিবীতে কোন খেলাই আজ কেবলমাত্র ভাল লাগার জন্য খেলা হয় না, কেউই আর অ্যামেচার নয়, খেলার সাথে জুড়ে গেছে আর্থিক সামাজিক বানিজ্যিক রাজনৈতিক স্বার্থ। অতীতের চোখ দিয়ে বর্তমান আর ভবিষ্যতকে দেখতে গেলে হতাশা তো হবেই। পেশাদারিত্বের এই যুগে যেখানে এসেছে আরো অনেক প্রযুক্তি, সেখানে খেলার বা প্রতিযোগীতার গুণগত মান অনেক উঁচু হয়েছে খেলোয়াড়দের নিজস্বতার বিসর্জনে, আর খেলার আঙিনা এখন টিঁকে থাকার লড়াইয়ের যুদ্ধক্ষেত্র। এ যেন লামার্কের প্রতিপাদ্যের নির্মম উদাহরণ – হয় অভিযোজন নয় বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া। 

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট পুরনো সেই সোনালী যুগের পুনরাবৃত্তি করতে পারে কিনা সেটা একমাত্র সময়ই বলতে পারবে। কিন্তু সেই ষাট থেকে আশির দশকের দুর্বার দিনগুলোর সাক্ষী হয়ে থাকবে উইজডেন, আর কিছু ধুলিধুসরিত স্মৃতি যারা সেই সময়কে প্রত্যক্ষ করেছিল, আর সেইসব প্রত্যক্ষদর্শীদের স্মৃতিচারণায়। তাদের মহাকাব্যিক বিবরণে তখনও দাপিয়ে বেড়াবে সোবার্স গার্নার মার্শাল রিচার্ডস লারারা, যদিওবা হয়তো সেই সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট থাকবে সেই আগুনে বছরগুলি থেকে এক আলোকবর্ষ বিপ্রতীপে।