Friday, 3 April 2015

আধুনিক বাঙলায় লুপ্তপ্রায় কিছু দৈনন্দিন শব্দ

অনেকদিন আগে ফেসবুকে একটা পোস্ট লিখেছিলাম ঘুলঘুলি শব্দটা নিয়ে। মূল বিষয় ছিল বাংলা ভাষায় কীভাবে নতুন সব শব্দ ঢুকে পড়ে আবার সময়ের সাথে সাথে বহুলপ্রচলিত শব্দরা কেমন করে হারিয়ে যায়। এখানে তেমন কিছু শব্দ তুলে ধরলাম যেগুলো ছেলেবেলায় প্রচুর ব্যবহৃত হত কিন্তু এখন কেমন আর শোনাই যায় না। কলকাতায় এই বিলুপ্তির হার বাকী বাংলার চেয়ে বেশীই মনে হয় কারন মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা কলকাতায় স্বাভাবিক কারনেই অনেক দ্রুত আর বেশী মাত্রায় পরিবর্তন হয়েছে। আর গৌড়চন্দ্রিকা না করে দেখে নেয়া যাক শব্দের লিস্টটা:

ঘুলঘুলি : এককালে সব পাকা বাড়িতেই থাকত হাওয়া আসার জন্য। ঘরে পাখি আসত সেই ঘুলঘুলিতে বাসা বাঁধার জন্য খড়কুটো নিয়ে। এখন শহর বা গ্রামে বেশির ভাগ বাড়িই পাকা কিন্তু দালান বাড়ি নয় তাই জানলাতেই কাজ চলে যায়। ফ্ল্যাটেও তাই। পুরনো বাড়িঘর বাদে ঘুলঘুলিও তাই বিলুপ্তির পথে, সেই সাথে শব্দের পরিচয়ও। 

হ্যাজাক : এই কথাটা কোথা থেকে বাংলায় এল ভেবে বার করতে পারলামনা কিন্তু প্রতিশব্দ হল পেট্রোম্যাক্স। যখন বেশির ভাগ গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি আর শহরে সেটা থাকলেও আদ্ধেক সন্ধ্যাবেলা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং চলত, সাধারন ঘরে ব্যবহৃত হত হ্যারিকেন, কিন্তু অবস্থাপন্ন বাড়িতে জ্বলত হ্যাজাক। আর চলত মুদির দোকানে। মাঝেমধ্যে ম্যান্টেল ফাটার জন্যে লোকে বাড়িতে ব্যবহারের সাহস দেখাতে পারতো না বটে, আর পুরো আলোর জন্য পাম্প দিতে অনেকক্ষণ লাগতো, কিন্তু হ্যাজাকের আলো যখন পুরো ছড়াত, ইলেকট্রিক বাতির আলো তার ধারেকাছেও লাগতো না। এখন গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে আর সাপ্লাইও অনেক ভাল, লোডশেডিং হয় কালেভদ্রে, তাই হ্যারিকেন হ্যাজাকের দরকারও ফুরিয়েছে, গুটিকয় মোমবাতি ঘরে রাখলেই নিশ্চিন্ত। হ্যাজাকের ব্যবহার হয়তো সীমিত প্রত্যন্ত গ্রামে ফসলের সময়, তাই শব্দের সাথে সাথে তার আকৃতি, ব্যবহার এসবও হারিয়ে যাবে। 

কুলো : একটা কারনে কুলো এখনো খুব পপুলার সেটা হল বিয়ের তত্ত্ব সাজানোর। তাই কুলোর ব্যবহার যে এখনই লোপ পাবে তা হয়তো নয়। কিন্তু কুলোর আসল ব্যবহার যে দুরকম ঘনত্বের জিনিসকে আলাদা করা সেটা সম্ভবত চাষাবাদেই সীমিত। যখন ছোট ছিলাম অনেক কালোবাজারি ব্যবসায়ী ছিল চারদিকে, চাল ডালে কাঁকড় খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল, তাই কুলো ছিল অপরিহার্য এই কাঁকড় বাছার জন্য। এখন বেশীরভাগ ব্যবসায় চালায় পাইকারী ব্যবসায়ীরা, আর লোকেও বেশী পয়সা দিতে প্রস্তুত খাঁটি জিনিসের জন্য। কুলোর সেই ঝাড়াইবাছাই ব্যবহার তাই এখন অচল। 

ঘুঁটে : মনে আছে কলেজে পড়তে যাবার দ্বিতীয় দিন সবাইকে ঘুঁটে দিতে হয়েছিল হোস্টেলের দেয়ালে। বাড়িতে বহুদিন কয়লার উনুনের চল ছিল তাই সেই উনুন ধরাতে ঘুঁটে ছিল আবশ্যিক। কয়লার বাক্সের পাশে থাকত ঘুঁটের বাক্স। গ্রামের মাটির চুল্লিতেও একই রকম পদ্ধতি। এখন লোকে হয় এলপিজি নয় কেরোসিন স্টোভ ব্যবহার করে, এতে জ্বালানিরও সাশ্রয় হয় আর ইচ্ছেমত জ্বালান নেভান যায়। কয়লার উনুন আর সেইসাথে ঘুঁটের চলও এখন নেই বললেই চলে। গ্রামে গরীব ঘরে হয়তো এখনো চলে ঘুঁটে কিন্তু কতদিন চলবে কে জানে। 

খোল : না বালিশের খোল নয়, আর খোল কর্ত্তালের খোলও না, এটা হল সর্ষের খোল। কলুর বলদ দেখেছি এক দুবার কিন্তু এমনিতে ঘানিগুলো চালায় লোকে ইলেকট্রিকে নয় হাতে চালানো মেশিনে। ঘানিতে সর্ষের তেল পিষে নেবার পর বাকী সর্ষের খোসা আর শস্যের যে বাদামী চাকলা গুলো পড়ে সেই খোল। ঘানির থেকে নামমাত্র পয়সায় কিনে সেই খোল জলে ভিজিয়ে রাখার পরদিন যে অখাদ্য দুর্গন্ধের মিশ্রণ তৈরী হয় বিকল্প সার হিসাবে বাড়ির বাগানের ফুলফলের জন্য যথেষ্ট। আজকাল সেই স্বাবলম্বী ঘানি তেমন নেই বিশেষ করে শহরে, প্রতিযোগীতার যুগে ধারা, ইঞ্জিনের সাথে তাল মেলাতে না পেরে এরা বিকল্প ব্যবসার সন্ধানে তেমনি প্রসেস করা পদ্ধতিতে খোলের পরিমান কম আর সেটা যে কোথায় যায় জানা নেই। যদি এখনো না হয়ে থাকে, মনে হয় অন্তত শহরাঞ্চলে সর্ষের খোল কথাটার তাৎপর্য কেমন থাকবেনা ভবিষ্যতে। 

মুটে : মুটে আর কুলির মধ্যে তফাত মনে হয় মুটেরা হল কুলীন, কুলিরা যেকোন ধরনের ভার বায় যেখানে মুটে সাধারণত বয় বাজারপত্র। মুটেদের সথে থাকতো এক বড় ঝাঁকা মাল বওয়ার জন্য। বড় মুদির দোকানের বাঁধা খদ্দেরদের জন্য মুটে থাকত বাজার বাড়ি পৌঁছে দেবার জন্য। আগে বাজার হতো মুলত মাসকাবারি তাই মুটের ঝাঁকা ভর্তিই হয়ে যেত। এখন মাসকাবারি বাজার প্রায় উঠেই গেছে তাই ঝাঁকামুটে মাইনে দিয়ে রাখাও দোকানগুলোর পক্ষে তেমন লাভজনক রইল না। তারা হয় এখন বেছে নিয়েছে অন্য জীবিকা না হয় কৌলিন্য বিসর্জন দিয়ে কুলিগিরি করছে।

দালান : দালানের উল্লেখ সাহিত্যে অনেক আছে কিন্তু এখনকার দিনে খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। গ্রামে আগে বাড়ি বলতে কাঁচাবাড়ি অর্থাৎ মাটির বাড়ি আর পাকাবাড়ি মানে ইঁট বালি সিমেন্টের বাড়ি। সংজ্ঞা বলতে গেলে যে পাকাবাড়ি গুলো আকারে বেশ বড় আর অন্তত একটা ধারের পুরোটা না হলেও অনেকটাই জুড়ে আছে লম্বা বারান্দা আর কলাম, সেটাই দালান বাড়ির বৈশিষ্ট্য আমার মনে হয়, এটা ঠিক না ভুল জানা নেই। সেই অর্থে কেউ চারতলা বাড়ি বানালেও সেটা যে দালান বাড়ি তার কোন কারন নেই। আজকের বাজারে জমির দাম যেখানে আগুন শহরে কী গ্রামে, মানুষ দালানবাড়ি বানানোর কথা মনে হয় স্বপ্নেও ভাবেনা। একটু বেশী জমি থাকলে সেটা প্রোমোটারদের দিয়ে বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি বানিয়ে নিজে গোটাকয় ফ্ল্যাট নেয়া এটাই চল। দালান জানতে হলে হয় পুরনো জমিদারবাড়ি অথবা গ্রামের দিকে এককালে বর্ধিষ্ণু-বর্তমানে শহর/বিদেশবাসী কিন্তু পুজোয় ফেরা পরিবারগুলোর আদি বসতবাড়ি, এই দুইই ভরসা। 

ভর : পদার্থবিজ্ঞানে ভর হল কোন বস্তুর মৌলিক ধর্ম। সেই ভরের কথা হচ্ছেনা, এটা হল সেই প্রথা যেখানে বিভিন্ন দেবদেবীর ভর হয় মানুষের ওপর। সাধারণত এয়ো স্ত্রীদের ওপরই ভর করে, তাকে ঘিরে বাকী মহিলারা তারস্বরে উলুধ্বনি দেয় আর ভর হওয়া মহিলা তার খোলা চুলসহ মাথা সজোরে নাড়াতে থাকে। ভর হবার পর কী হয় তার সঠিক বিবরন মনে পড়ছেনা, খুব সম্ভব বাকী লোকে লাইন দিয়ে তাদের আশা ইচ্ছা পেশ করে। ভরের চল হয়তো এখনও আছে কিন্তু সংখ্যা অনেক কম, গ্রামেগঞ্জে সীমিত। 

(চলবে)


No comments: