কয়েক দশক আগেও বেড়ে ওঠার সময়ে বিভিন্ন গল্পগাথার মধ্যে ভুতের প্রভাব ছিল অনেকটাই। "ভুত আমার পুত পেত্নী আমার ঝি রাম লক্ষ্মন বুকে আছে ভয়টা আমার কী" এই জাতীয় ছড়া বা অন্ধকার রাস্তায় রাম রাম বলা জাতীয় আচার ছিল বহু প্রচলিত। অনেকে এখন ছেলেমেয়েদের আবেগতাড়িত হয়ে বাংলা শিশুসাহিত্য পড়ায় বটে কিন্তু মনে হয়না সেটা স্বতঃস্ফুর্ত। ইংরেজী পাঠ্যক্রম আর টিভি/সিনেমার দৌলতে অনেক বিদেশী ভুতের নামই জানা যায় কিন্তু ভুত আর পেত্নী বাদ দিয়ে বাংলায় আরো যে সুনির্দিষ্ট ভুতের নাম আছে সেগুলো শিশুসাহিত্যের পাঠ কমার সাথে সাথে কমেছে। সবগুলো আমারও জানা নেই তবে চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক কিছু নামে যেগুলো মনে পড়ছে-
ব্রহ্মদৈত্য-ভুতেদের জিউস বা পালের গোদা, বামুন মরে ভুত হলে ইনি জন্মান। যে গাছে ব্রহ্মদৈত্য থাকে খুব সম্ভব সে গাছে অন্য ভুত থাকেনা। এরা সাধারণত খুব একটা ক্ষতি করেনা, বরং অন্য ভুতদের কন্ট্রোল করে।
আলেয়া-জলাজমিতে মিথেন গ্যাস এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। জ্বলতে নিভতে থাকা আলো। সাধারণত রাতে পথিককে আল থেকে আলে ঘুরিয়ে মারা এর উদ্দেশ্য। সব ভৌতিক ঘটনার মধ্যে আলেয়াই একমাত্র দেখা যায় আর তার একটা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা আছে।
কানাওলা/কানাভুলো-মনে হয় আলেয়ার প্রকারভেদ। তবে কানাওলা নেহাতই ভুত, আলেয়ার মত অন্য কোন রূপে প্রকাশ পায় না। সাধারণত পথিকদের ওপর ভর করলে তারা দিক ভুলে যায় আর একই পথে চক্কর খেতে খেতে কাহিল হয়ে গেলে তখন তাকে নির্জন মাঠেঘাটে নিয়ে গিয়ে ফেলে। কানাওলায় পাওয়া মানুষ যদিও পরদিন ফিরে আসে যদি না রাস্তা হারিয়ে জলে ডোবে।
নিশি-ছোটবেলায় নিশি শুনলেই ভয়ে লোম খাড়া হয়ে যেত, লিখতে বসে এখনও হচ্ছে। নিশি রাতে চেনা লোকের গলায় ঘুমন্ত মানুষকে ডাকে। সাড়া দিলেই সে নিশির কবলে পড়ে গেল, তাকে আর কেউ কখনো দেখতে পায় না। তিনবার ডাকলে তখন নিশ্চিন্ত হওয়া যায় সেটা নিশি না।
শাঁকচুন্নী-এদের গলা খুব খোনা হয়, মহিলা ভুত সধবা অবস্থায় মারা গেলে অন্য মহিলাদের ওপর ভর করে। খুব সম্ভব শ্যাওড়া গাছে থাকে।
কবন্ধ-খুব সম্ভব স্কন্ধকাটার আর এক নাম।
স্কন্ধকাটা-মাথা কাটা গিয়ে ভুত হলে তারা স্কন্ধকাটা হয়। এরা লোককে তাদের মাথা খুঁজে দেবার জন্য ধরে।
মামদো-এরা যে কি ধরনের ভুত তার কোন ধারনা নেই। কোথাও পড়েছিলাম মামদোর ছানারা বেশ মিস্টি হয়। মামদোরা তেমন ক্ষতিকর ভুত নয়, ফালতু ঝামেলা করাই এদের মূল উদ্দেশ্য অনেকটা পল্টারগাইস্টদের মতন।
মেছোভুত-মনে হয় সবচেয়ে নিরীহ আর ছাপোষা ভুত এরাই। পুকুর জলার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে আর লোক দেখলে তাদের মাছ ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।
পেঁচো-এর সম্বন্ধেও প্রায় কিছুই জানা নেই। পেঁচোয় ধরলে বোধহয় লোকে মৃগীরুগীর মত ছটফট করে।
পেত্নী-সব মেয়ে ভুত যে পেত্নী তা নয়। পেত্নী মাত্রই তবে মেয়েদের ভুত। এরা সাধারণত মেয়েদের রূপ ধারণ করে থাকে শেষ মুহূর্ত অবধি। মানুষদের ঘাড় মটকে মেরে ফেলাই এদের লক্ষ্য। পেত্নীদের পা উল্টোদিকে ঘোরানো থাকে যা দেখে এদের চেনা যায়, আর সেইজন্য তারা শাড়ী দিয়ে পায়ের পাতা ঢেকে রাখে।
এই শব্দগুলো ছাড়াও লোকসাহিতে্য অন্যান্য নামের ভুতের উল্লেখ পাওয়া যাবে বিশেষ করে বিভিন্ন আঞ্চলিক শব্দ যা শুধু সেই এলাকায় চলে যেমন বেঘো ভুত সুন্দরবনে। অনেক ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক নামগুলো একই ধরণের ভুতের বিকৃতি।
ভুত আছে কি নেই সেটা একটা বড় প্রশ্ন যেখানে জড়িয়ে আছে বিশ্বাস আর অবিশ্বাস। আমি অবিশ্বাসী আর সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একমাত্র আলেয়ার অস্তিত্ব প্রমাণিত আর তার বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষন আছে। বাকী বেশীরভাগই মানুষের কল্পনা ভয় আর রাতের আলো আঁধারির যোগফল। আর কিছুটা অন্যান্য লোকের ছড়ানো গল্প যার পেছনে কোন মতলব থাকে। আজকের দিনে যেখানে জলা পুকুর সব বোজানো হচ্ছে আর জঙ্গল সাফ হয়ে যাচ্ছে সেখানে এইসব আলো আঁধারির আর তেমন মানুষের মনের সাথে ছলচাতুরি করার জায়গা নেই বিশেষ করে যখন রাস্তায় রাস্তায় আলোর ছড়াছড়ি। ভুতেরাও সেইজন্য বোধহয় পালিয়ে চলেছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। ভুত না থাকলেও তবু ভয়টা কিছুটা রয়েই যায় যেটা প্রকাশ পায় অন্ধকার রাস্তায় চলার সময় বা রাতে নির্জন শ্মশানে গোরস্থানে তবে সেটা ভুতের না হঠাৎ অজানা কোন কিছুর সামনে পড়ার সেটা বলা মুস্কিল। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা যুক্তি দিয়ে এই ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষন করে প্রমান করি যে আপাতভাবে যে ঘটনাগুলো ভৌতিক মনে হয় তার পেছনে একটা ব্যাখ্যা আছে। তবে স্থান-কাল-পাত্র নিরীখে অনেক সময় যুক্তি ব্যবহার করা যায়না, যেখান থেকে ভুতের ব্যুৎপত্তি, যেভাবে প্রাচীনকালে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ভগবানের হস্তক্ষেপ বলে মনে করা হতো।
ভুতের ভবিষ্যৎ কী সেটা অনেকটা নির্ভর করবে আগামী দিনে লেখক আর পাঠকদের ওপর। বিংশ শতকের সাহিত্যে ভুতের অনেক উল্লেখ পাওয়া যাবে কিন্তু নতুন পাঠকরা যদি সেই লেখার সাথে পরিচিত না হয় তবে ভুতেরাও হারিয়ে যাবে এই লেখাগুলোর সাথে সাথে। আর সেখানে নতুন লেখকদের প্রসঙ্গ আসছে, তাদের লেখায় এই বিগত শতকের লেখার কতটা প্রভাব থাকবে তার ওপর নির্ভর করবে আগেকার ভুতের প্রকারগুলো বজায় থাকবে না পাল্টে যাবে আধুনিক জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে, যেমন সাম্প্রদায়িক ভুত, টেররিস্ট ভুত ইত্যাদিতে। তবে বলাই বাহুল্য যে এই বিভিন্ন ধরনের ভুত যা বাঙালি জীবন আর সাহিত্যে বিরাজ করেছিল, সেটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে, শুধু থাকবে হয়তো একটা কমন শব্দ ভুত বা পেত্নী।
No comments:
Post a Comment