প্রথম সাক্ষাত হয়েছিল বছর দশেকে যেবার বাবা অফিসের লাইব্রেরি থেকে সমগ্র কিশোর সাহিত্য এনে দিয়েছিল পড়ার জন্য। সেই ডি -লা- গ্র্যান্ডি-মেফিস্টোফিলিস আর মঁসিযো ভেনেজাভেক মোআ এর সাথে পরিচয় হবার সময় থেকে ফরাসী ভাষার ওপর যে টান জন্মেছিল যত বয়েস হয়েছে সেই টান আরো অনেকগুণ বেশি হয়ে এসেছে আমার কাছে। তারপর জানলাম রেনেসাঁস, ফরাসী বিপ্লব, ভিক্তর উগো, দুমা, সেখান থেকে কলেজ জীবনে কামু, সার্ত্র, সিমন দ বুভোয়া হয়ে ফরাসী নুভেল ভাগ বা নিউ ওয়েভ সিনেমায় গোদার, ত্রুফো - মোটের ওপর ফ্রান্স আর ফরাসী ভাষা এমন এক ইন্দ্রজাল তৈরী করেছিল যার ফল হলো ২০০৬এ শনি রবিবার পাড়ার আড্ডার মায়া কাটিয়ে আবার খাতা বই পেন নিয়ে আলিয়াঁস ফ্রঁসেস এর বেকবাগানের ক্লাসরুমে হাজিরা। সেখান থেকে শুরু হলো এক নতুন যাত্রা, ফ্রান্স আর ফরাসী ভাষাকে নতুন ভাবে জানার বিশেষ করে আধুনিক যুগের, বিশ্বযুদ্ধের পরের আর একুশ শতকের জীবনযাত্রা। আলিয়াঁস এর লাইব্রেরি থেকে শেষ করলাম টিনটিন আর অ্যাসটেরিক্স, অনেক অপেক্ষার পর শেষে হাতে পেলাম গোদারের ল পেতি সোলদা। যাওয়া শুরু হল মঙ্গলবার সন্ধ্যাবেলা নন্দন-২ তে আলিয়ান্স এর কার্ড দেখিয়ে ফ্রি ফরাসী সিনেমায় । ২০০৮ এ তল্পিতল্পা গুটিয়ে ইংল্যান্ড আসার পর রসদের টানাটানি অনেকটাই কমে গেল। ইউটিউব আর টরেন্ট থেকে দেখে ফেললাম একের পর এক অদ্রে তোতুর সিনেমা- কি অসাধারন অভিনেত্রী, কি অনায়াসে সব জটিল রোল প্লে করেছে। দেখলাম রোমাঁ দুরিসের ছবি, মোহিত হয়ে গেলাম লারা ফাবিয়াঁর মায়াবী রূপে আর তারও বেশী এক জোরালো, মনকে নাড়িয়ে দেয়া কন্ঠস্বরে। এরই মাঝে এক বৃষ্টির দুপুরে লন্ডনে হাঁটতে হাঁটতে কুড়িয়ে পেলাম এক ইউএসবি স্টিক, হাজার দোনোমনো করে খুলেই ফেল্লাম ফাইলটা, আর হাতে পেলাম আধুনিক ফরাসী সিনেমার সুপারহিট "বিয়াঁভেন্যু শে লে শ'তি", যেখানে এক দক্ষিণ ফ্রান্স নিবাসী কর্মীর বদলি হয় নর্দ-পা-দ-ক্যালে (Nord-pas-de-Calais) যেটা হল ফ্রান্স এর একদম উত্তরে, ভুমধ্যসাগরীয় জলবায়ুতে অভ্যস্ত মানুষের সেখানে যাওয়া কেরল থেকে কারো সিমলা যাবার সমান। মূল বক্তব্য থেকে অনেকটা সরে এসেছি। ব্রিটেন আসার পরও, এতো কাছে হওয়া সত্বেও, ফ্রান্স বহুদিন অধরাই থেকে গেছে। ফরাসীর সাথে যা যোগাযোগ তা ছিল শুধু কিছু সিনেমা আর Spotify এ লারা ফাবিয়াঁ আর কামিল-এর গান আর কালেভদ্রে লে মোঁদ এ চোখ বুলিয়ে নেয়া। ইউরোপে যাবার ভিসা পাওয়ার অনেক হাঙ্গামা দেখে আর এগোইনি। বিয়ের পর ইউরোপ যাবার অনেক পরিকল্পনা করে একটা ভিসা পেলাম বটে কিন্তু প্রায় একই সময় সোফিয়া নামক দুর্যোগের প্রাবির্ভাব ঘটায় সেই সব প্ল্যান এক বছর পিছিয়ে গিয়েছিল। অবশেষে গেল জানুয়ারিতে সোফিয়ার পাসপোর্ট তৈরী হবার পর সুযোগ এল সেই বহুদিনের আকাঙ্খা পূর্ণ করার। বাড়ি থেকে ফ্রান্স ১০০ মাইলও না, তবু দুরত্বটা মনে হচ্ছিল অসীম এতদিন ধরে। আলিয়াঁসের ক্লাসের সুত্রে মনে মনে যদিও ঘুরে নিয়েছি লুভ্র, আইফেল টাওয়ার, আর্ক দু ত্রিয়োঁফ, শঁজেলিজে। শুধু প্যারিস না, কল্পনা ছুঁয়ে গেছে সাঁ মালোর আর্ট মেলা, আল্পসের শ্যালে, পার্ক আস্তেরিক্স এমনকী সুদুর মার্তিনিকের ধবধবে সাদা বীচ অবদি, কিন্ত চাক্ষুষ কিছুই দেখা হয়নি। প্রচুর জমিয়ে রাখা আশা নিয়ে শেষে ১৪ই ফেব্রুয়ারী উঠে পড়লাম সপরিবারে ক্যালে মুখী ফেরীতে। মেয়ের প্রথম বিদেশ ভ্রমন, তার ওপর জীবনে প্রথম রাস্তার উল্টোদিকে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা এসবের মাঝেও মনে মনে ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম দৈনন্দিন ফরাসী শব্দগুলো, ঠিকই করে ফেলেছিলাম নির্ঘাৎ আতান্তরে না পড়লে ফরাসীতেই কথাবার্তা চালাবো। বেলা ১টা নাগাদ বহুযুগের সেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে পা রাখলাম ক্যালের সমুদ্রতীরে, চোখ ভরে শুষে নিলাম বাড়ি ঘর, পোষাক আশাক রাস্তার দোকানের সাইন...আর শুনে নিচ্ছিলাম কথার মাঝের চন্দ্রবিন্দুগুলো, যা ইংরেজীতে একেবারেই বিরল। হয়তোবা বাকী রয়েছে এখনো রাতের আলোয় মায়াবী প্যারিস দেখা, কিন্তু দেখা হয়ে গেল সেই বিয়াঁভেন্যু শে লে শ'তির ক্যালে। মনে হল যেন বাস্তব ছুঁয়ে গেল রূপকথার দেশকে, হয়তো এতদিন ফ্রান্স ও ছিল আটলান্টিস এর মতই কল্পনার রাজ্যে সীমিত, কিন্তু সেই মূহুর্তটার পর থেকে বলতে পারব যে খানিকটা ফ্রান্স এখন থেকে আমার মধ্যেও রয়েছে।
পরিশেষ: শুনেছি, সিনেমায় দেখেছিও অনেক এই নিয়ে কিন্তু এখন হলফ করে বলতে পারি ফরাসীদের মত চুমু খেতে কেউ পারেনা। ব্রিটেনেও সবাই রাস্তাঘাটে চুমু খায় কিন্তু সেটা গড়ে ১০ সেকেন্ডের বেশীক্ষণ ধরে না। ফ্রান্সে সেই গড় দাঁড়াল প্রায় ৩০ সেকেন্ড।
No comments:
Post a Comment