Monday, 19 October 2015

তেইদে উপত্যকায় একদিন

অতলান্তিক মহাসাগরের বুকে আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর পশ্চিম কোণে সাতটি দ্বীপ। স্পেনের অধীনে তাই স্পেনীয় ভাষায় এদের নাম Islas Canarias বা ক্যানারী দ্বীপপুঞ্জ। তার মাঝে সবচেয়ে বড় দ্বীপ হলো Tenerife। স্পেনীয়রা উচ্চারণ করে তেনেরিফে, ইংরেজরা বলে টেনেরিফ, খটখটে জার্মানরা আরো এককাঠি ওপরে গিয়ে বলে টেনেরিফফা। আকার প্রকারে বিশেষ বড় না হলেও পশ্চিম জগতে তেনেরিফে বেশ চেনা নাম। প্রতি বছর ঝাঁকে ঝাঁকে ইংরেজ ফরাসী জার্মান পর্যটকরা ভিড় করে ক্যানারী দ্বীপপুঞ্জে বিষুবরেখার কাছাকাছি সূর্যের পুরো তেজ উপভোগ করার জন্যে। তার ওপর আছে অতলান্তিক মহাসাগরের সুনীল উচ্ছ্বল জলরাশির হাতছানি। সেসব বিবেচনা করে সোফিয়ার প্রথম বিমানযাত্রার গন্তব্য হিসেবে ঠিক করলাম অক্টোবরের তেনেরিফে, যাতে গ্রীষ্মকালের আগুনে তাপের বদলে শরতের উষ্ণ আবহাওয়ায় ছুটিটা উপভোগ করা যায়। সাতদিনের সেই অবিস্মরনীয় অভিজ্ঞতার পুরো বর্ণনা দেয়া অসাধ্য, তাই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিনটার কথাই বিশদভাবে লিখলাম এখানে, তবে সেই সাথে রইল তেনেরিফের একটা সংক্ষিপ্ত ছবি।

তেনেরিফে দ্বীপটার আকার অনেকটা কাঁচা হাতের বানানো প্রথম পরোটার মত - এমনিতে তিনকোনা, উত্তর দিকটা যেন ত্রিভুজের একটা বাহু তারপর পূর্ব আর পশ্চিম দিকের দুটো বাহু দক্ষিনে গিয়ে মিশেছে। আর উত্তর পূর্ব দিকটা যেন খানিকটা টেনে লম্বা করা। ক্যানারী দ্বীপপুঞ্জ হলো অতলান্তিক মহাসাগরের বুক ফুঁড়ে ওঠা কিছু আগ্নেয় পর্বতের সমষ্টি, বহু বছর ধরে উদ্গীরণের লাভা জমে জমে দ্বীপগুলোর সৃষ্টি। তেনেরিফের অন্যতম বৈশিষ্ট সেরকমই এক আগ্নেয় পর্বত Pico de Teide বা তেইদে পর্বতশৃঙ্গ। শেষ অগ্ন্যুৎপাত হয় ১৯০৯ সালে, সেই তেইদে পর্বকেই বলা যেতে পারে তেনেরিফের মূল কেন্দ্র। তেইদে থেকে শুরু করে গোটা দ্বীপটার চারদিকে আগ্নেয় পাথরের পর্বতমালা, যার উচ্চতা তেইদের আশেপাশে ২৫০০মি থেকে কমতে কমতে একদম তটরেখার কাছে হঠাৎ ঢালু হয়ে সমুদ্রে মিশেছে। একেবারে দক্ষিনে যেখানে ত্রিভুজের দুই বহু মিলেছে সেখানে খানিকটা সমভূমি, বাকি যে কোনো দিকে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের উল্টোদিকে চাইলেই দেখা যাবে পাহাড় শুরু হয়ে গেছে আর সবার মাথা ছাড়িয়ে সুদূরে অবস্থান করছে সেই তেইদে যা স্পেনের সর্বোচ্চ পর্বতশিখর। দক্ষিন আর পূর্বদিকের পাহাড়গুলো ঊষর আগ্নেয় পাথরে তৈরী তবে পশ্চিম আর উত্তরে তাকালে দেখা যাবে সবুজ পাহাড়ের রাশি। সেই সব পাহাড়ের রাশি আর সমুদ্র তার মিশ্রনে তৈরী হয়েছে প্রকৃতির এক অননুকরণীয় ভূমিরূপ। বিচ মানেই যে সোনালী বালুকাবেলার ধারণা করি আমরা তেনেরিফের তট তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। আগ্নেয় পাথরের আর লাভার সংমিশ্রনে সেই বালির রং ঘোর কালো। সেই কালো সমুদ্রতটে যখন আছড়ে পরে উদ্দাম অতলান্তিক মহাসাগরের ঢেউ, আর দুরে চাইলে সমুদ্র আর আকাশের নীল যে কোথায় মিশেছে তা ঠাহর করা যায়না, তখন মনে হয় প্রকৃতি তার নিজের খেয়ালে এই পৃথিবীকে কি অপুর্বভাবেই না সাজিয়েছে।
পুয়ের্তো দে লা ক্রুজ সমুদ্রতট 
তেনেরিফেতে যে শহরে আমরা ছিলাম তার নাম পুয়ের্তো দে লা ক্রুজ, উত্তর দিকে এক বড় শহর। উল্লেখ্য যে এই দ্বীপের বেশির ভাগটাই পাথুরে পর্বত বলে তেনেরিফের সব বড় শহরগুলোই একদম সমুদ্রের ধারে। পুয়ের্তো দে লা ক্রুজ থেকে হাইওয়ে পশ্চিমে চলে গেছে ইকদ দে লস বিনোস হয়ে গারাচিকোর  দিকে যেখানে সমুদ্রে সারি সারি ডলফিন খেলা করে, অনেকে যায় সমুদ্রে শুধু ডলফিন দেখতেই। অন্য দিকে হাইওয়ে প্রথমে পূর্বে তারপর দক্ষিনে বাঁক নিয়ে তেনেরিফের প্রধান শহর সান্তা ক্রুজ দে তেনেরিফে ছুঁয়ে চলে গিয়েছে দক্ষিনে এয়ারপোর্টের দিকে লস ক্রিস্তিয়ানোস, আদেখে অবধি। দ্বীপের এই উত্তর দক্ষিন বিভাগের সাথে জুড়ে আছে মানুষের বেড়ানোর পছন্দ অপছন্দ। দক্ষিন দিকটা খুব বানিজ্যিক, হোটেল বাড়িঘর সব চোখধাঁধানো, খাবারের রেস্তোঁরার রকম অগুন্তি। এদিকে বিশেষ করে আসে ইংরেজরা মার্কিনরা তাদের দেশের বাইরে দেশের সুযোগ সুবিধা স্বাচ্ছন্দ্য বেশি প্রিয়। অন্যদিকে উত্তর দিকে গেলে সবই স্পেনীয়। খাবারের জায়গাগুলো মূলত স্পেনীয় খাবারই বিক্রি করে আর বাড়িঘর সাধারণ। স্পেন দেশে গিয়ে সেখানকার মানুষদের আদব কায়দা রীতি নীতি শিল্প ভাস্কর্য দেখতে হলে উত্তরই শ্রেষ্ঠ। এদিকের বেশীরভাগ থাকতে আসা লোকই জার্মান। উত্তর বেশ প্রাকৃতিক, দক্ষিন সে তুলনায় বেশ কৃত্রিম। তেনেরিফের পূর্ব দিক জুড়ে ছড়িয়ে আছে অনেক ছোট ছোট শহর।  পশ্চিম দিকটা সেই তুলনায় অনেকটা দুর্গমই বলা চলে, তবে সেদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও সেই তুলনায় অপূর্ব।
পুয়ের্তো দে লা ক্রুজ
যে দিনটা নিয়ে লেখার অবতারণা সেই দিনের কথায় যাওয়া যাক। তেনেরিফের উত্তর দক্ষিন সব দিকের রিসর্টগুলো থেকেই তেইদে পর্বতের একটা আদ্ধেক দিনের ট্যুর করা হয়।  তেইদের মূল আকর্ষণ হলো পর্বতের বেস ক্যাম্প থেকে রোপওয়ে যেটা প্রায় হাজার মিটার উঠে তেইদের প্রায় চূড়ায় পৌঁছে দেয়। তবে সেই ওপরের স্টেশন থেকে তেইদের চূড়া আরো ২৫০মি আর সেখানে উঠতে গেলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগে, তাই সাধারণ ট্যুরিস্টরা রোপওয়ের শেষে গিয়ে খানিক ঘুরেই ফিরে আসে। ট্যুর গুলো সাধারণত বাসে করে নিয়ে যায়, তাদের তাড়া থাকে আদ্ধেক দিনে সবাইকে ফিরিয়ে আনার, তাই বেশিক্ষণ কাটানো যায়না। সেই সব  বিবেচনা করে আগেই ঠিক করেছিলাম গাড়ি ভাড়া করেই যাব। যে গাড়ি ভাড়া পাওয়া গেল সে তো এক টিনের কৌটো বলা যেতে পারে, তাও একদিন আগে ভাড়া নিয়েছিলাম বলে রক্ষে পাহাড়ি রাস্তায় যাবার আগে বাঁহাতি গাড়ি চালানোর প্রথম অভিজ্ঞতা নাহলে তেমন উপভোগ্য হতোনা। এক দিন চালিয়েও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি ব্যাক গিয়ারটা ঠিক কিভাবে কাজ করে। যাহোক সকালের দিকে কাতারে কাতারে বাস ভিড় করে তেইদেতে তাই যেতে হবে খুব সকালে বা দুপুরের দিকে। ধীরেসুস্থে দুপুরে যাওয়াটাই ঠিক করলাম কারণ সকালের দিকে কুয়াশায় পর্বতের ওপর থেকে কতটা দেখা যাবে সেই ভেবে। ১১টা নাগাদ যাত্রা শুরু হলো পুয়ের্তো দে লা ক্রুজকে পেছনে ফেলে। শহরে যাবার মূল রাস্তা যেখানে হাইওয়েতে মিশেছে সেখানে ডানদিকে মোড় নিয়ে শুরু হলো চড়াই ভাঙা। হাইওয়ে ছেড়েই প্রথম রাস্তায় পড়বে লা ওরোতাবা (La Orotava) বলে একটা ছোট আর সুন্দর শহর। লা ওরোতাবায় নাকি তেনেরিফের যত নামজাদা লোকজন তাদের বাড়িঘর ছিল আঠার উনিশ শতকে।শহরের মেন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতেই মনে হছিল রাস্তার চড়াই বেশ খাড়া। ওরোতাবাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চললাম পিকো দে তেইদের দিক নির্দেশ করা রাস্তা ধরে। রাস্তার দুপাশে টিপিক্যাল স্পেনীয় বাড়িঘর, এক এক বাড়ির এক এক রকম আকার আর রঙ, পশ্চিম ইউরোপের মত একঘেয়ে লাল টালির নয়।  বাড়ি দোকান এসবের পেছনে ঘন গাছগাছালি তারপর পাহাড় উঠে গেছে ওপরের দিকে। অন্য দিকে ঢালের দিকে তাকালে নিচে ওরোতাবা আর আরো দুরে পুয়ের্তো দে লা ক্রুজের সীমানা ছাড়িয়ে দিগন্তরেখা অবধি সুনীল অতলান্তিক। খানিক রাস্তা হারিয়ে তারপর ফের আসল রাস্তা খুঁজে পেয়ে এগিয়ে চলল গাড়ি একে একে ছোটো ছোটো জায়গা পেরিয়ে। আসিয়েন্দা পের্দিদা, সিয়েরা ইত্যাদি ছাড়িয়ে প্রথম স্টপ চাসনা বলে একটা জায়গায় শুধু দেখে নেয়া নিচে ফেলে আসা ওরোতাবা উপত্যকা। এখানেই ঘটল অঘটনটা। জেনিফার গোটাকয় ছবি তুলে ফিরেছে, সোফিয়া ঘুমোচ্ছে, ঢালে গাড়ি ব্যাক করতে গিয়ে দেখি গিয়ার কাজ করছেনা, আর যতবার চালু করার চেষ্টা করছি গাড়ি ততবারই খানিটা করে গড়িয়ে সামনের পাথরের দেয়ালের দিকে এগিয়ে চলেছে। যখন ইঞ্চি দুই দুরে, কপালজোরে ব্যাক গিয়ারটা লেগে গেল, আমরা আবার ১০মিনিট ঘাম ঝরিয়ে এগিয়ে চললাম আগুয়ামানসা বলে একটা জায়গার দিকে। একে একে দেখছি উচ্চতা পাল্টাতে আরম্ভ করেছে রাস্তার ধারের মার্কারগুলোয়। আগুয়ামানসা প্রায় ১৩০০ মিটার উঁচুতে সমুদ্র থেকে। আগুয়ামানসার পর রাস্তার দুপাশের দৃশ্য বদলে গেল।  ঘরবাড়ি আর নেই এবার দুদিকেই ঘন চিরহরিৎ গাছের জঙ্গল। পাহাড়ি গাছগাছড়ার সাথে তেমন পরিচিতি নেই তাই পাইন আর রোডোডেনড্রন এদুটোই শুধু চেনা গেল। খানিক পর পরই এই জঙ্গলে ঘেরা রাস্তার মাঝে ভিউয়িং পয়েন্ট যাতে লোকজন থেমে সামনের দৃশ্য দেখার জন্য থামতে পারে। এখান থেকে উত্তরের দৃশ্য অসামান্য। নিচে তাকালে ঘন গাছের মাথা ছাড়িয়ে পুয়ের্তো দে লা ক্রুজ তখন পিং পং বলের মত ছোট।  বাকি চারদিকে নীল আর নীল। কোথায় আকাশ আর কোথায় সমুদ্র তা হলফ করা দুঃসাধ্য, খালি সমুদ্রটা একটু যেন বেশি গাঢ় নীল। অন্যদিকে কুয়াশা ঢাকা পর্বত উঠে গেছে ওপরের দিকে, আর দুরে আবছা দেখা যাচ্ছে তেইদের সীমারেখা। নিচে পুয়ের্তো দে লা ক্রুজে ঝলমলে দিন হলেও এখানে ওপরের দিকে বেশ কুয়াশা, মনটা খানিকটা মুষড়ে গেল কুয়াশা কাটবে কিনা সেই চিন্তায়। রওনা দিয়ে ঠিক করলাম বেলা হয়ে যাচ্ছে আর থামবনা কোথাও তেইদের আগে। জঙ্গল যে কে সেই দুদিকে ছেয়ে আর দেখছি উচ্চতা একটু একটু করে বেড়েই চলেছে ১৫০০..১৬০০..১৭০০মি। 
পাইন অরণ্য তেইদের পথে 
প্রায় ১৮০০ মিটারে এসে একটা বাঁক নিয়েছি হঠাৎ চারপাশটা যেন আবার হুশ করে বদলে গেল। গাছপালা জঙ্গল নিমেষে উধাও, শুরু হয়ে গেছে পাথুরে পর্বতরাশি। আগ্নেয় পাথরের সেই ভূমিরূপে বিচিত্র সব রঙ হলুদ থেকে কমলা আর বাদামী থেকে কালোর কতরকমের যে সংমিশ্রণ হওয়া সম্ভব, সেই পাথুরে এলাকা না দেখলে বিশ্বাস হতনা। আর খানিকটা উঠে চোখে পড়ল বিরাট বড় সাইন পার্কে নাসিওনাল দেল তেইদে (Parque nacional  del Teide)।  এখান থেকেই শুরু তেইদের চড়াই। আমরা তখন প্রায় ১৯০০মি উঁচুতে, আকাশ ঝকঝকে নীল, কোনো মেঘের চিহ্নমাত্র নেই, কুয়াশা ফেলে এসেছি নিচে। প্রায় ২০০০মি উঁচুতে উপস্থিত হলাম এক আশ্চর্য জায়গায় যার নাম মিনাস দে সান হোসে (Minas de San José) বাংলায় অনুবাদ করলে সান হোসে খনি। রাস্তার দুপাশে গাড়ি দাঁড় করানোর জায়গা। এ জায়গা আগে ছিল ঝামা পাথরের খোলা খনি। এখানে পায়ের নিচে জমি কমলা বাদামী মেশানো রঙের ঝামা পাথরের কাঁকর। হাজার হাজার বছর ধরে আগ্নেয়গিরির লাভা, সূর্যের তেজ, দিন-রাতের তাপমাত্রার ওঠানামা আর তেজি হাওয়া এই সবে মিলে তৈরী করেছে সেই অসাধারণ ছবির মত ল্যান্ডস্কেপ। সেই কাঁকরে ঢাকা ঢেউ খেলানো জমি রাস্তার ডানদিকে উঠে গেছে তেইদেকে ঘিরে থাকা পর্বত গুলোর দিকে। এদিকে তাকালে কাঁকরে ঢাকা জমিতে মাঝে মধ্যে চাগিয়ে উঠেছে ছোট বড় পাথরের স্তুপ। আর তার পেছনে অনন্য গরিমায় দাঁড়িয়ে আছে তেইদে পর্বত, ২২০০মি উচ্চতা থেকে দেখলেও মনে হবে পর্বতের মাথা যেন আকাশকে ছুঁয়ে আছে। অন্যদিকে রাস্তার উল্টোপাড়ে সেই কাঁকুরে জমি অল্প ঢালে নেমে গিয়েছে নিচের দিকে। সেদিকে খানিক দূর গিয়ে বড় বড় পাথরের চাঁইগুলোর ভেতর দিয়ে নিচের দিকে তাকালে সে দৃশ্যাবলী মনের মধ্যে চিরদিনের জন্যে গেঁথে থাকবে। পাথরের স্তুপের পর জমি খাড়া নেমে গিয়েছে কয়েকশ মিটার কিন্তু তারপর সমতল জমি বিস্তৃত প্রায় কয়েক মাইল, তার শেষে পর্বতরাজি উঠে গেছে কয়েকশ মিটার। তেইদের চারদিকে সমতলভূমি পেরিয়ে এই পর্বতগুলো নির্দেশ করছে পার্কে নাসিওনাল দেল তেইদের সীমানা, যার উল্টোদিকে ঢাল নেমে গেছে ফেলে আসা পাইন অরণ্যের দিকে। বেশি দেরী হয়ে যাবার চিন্তায় হাতের আর মনের ক্যামেরায় ঊষর সেই তেইদে উপত্যকার ছবি সঞ্চয় করে এগিয়ে চললাম মূল আকর্ষণের দিকে, তেইদে পর্বত আর কেবল কার যার পোষাকী নাম তেলেফেরিকো দেল তেইদে। মূল রাস্তার থেকে ডানদিকে মোড় ঘুরে রাস্তা খাড়াই উঠে গেছে তেইদের এই বেস ক্যাম্পে।
মিনাস দে সান হোসে 
তেইদে উপত্যকা 
 তেইদের রোপওয়ের সেই নিচের প্রান্তে তখনো গাড়ির ছড়াছড়ি। মেন কারপার্ক ছাড়াও চড়াই রাস্তার আশেপাশে পাথরের ওপর অনেক পার্কিংয়ের জায়গা, সব ভর্তি। ভাগ্যক্রমে একটা জায়গা খুঁজে পেয়ে গাড়িটা রেখে রওনা দিলাম টিকিট কাউন্টারের দিকে। গিয়ে দেখি রোপওয়ের কর্মচারী বলছে সোফিয়ার ওপরে যাওয়াটা নিরাপদ নয়। রোপওয়ের অপরের প্রান্ত ৩৫৪০মি উঁচুতে, সেখানে অক্সিজেন তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের তেমন অসুবিধা না হলেও ছোট বাচ্চাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হতে পারে। এই সব ভেবে জেনিফার রয়ে গেল সোফিয়ার সাথে নিচে, আমি টিকেট কেটে দাঁড়িয়ে পড়লাম রোপওয়ের লাইনে। কেবল কারের এই জায়গাটা থেকে তেইদের শিখর দেখা যায়না। সামনের ঢালটা এত খাড়া যে চূড়াটা তার পেছনে ঢাকা পড়ে আছে। রোপওয়ে বলতে এলাহী ব্যাপার। বিরাট বড় বড় টাওয়ার তার দুদিকে দুটো কেবল লাইন, একটা কার যখন নিচে, অন্যটা তখন ওপরে, দুটো একসাথে যাত্রা শুরু করে সব সময়, ২৫০০মি থেকে ৩৫৪০মি এই পুরো দূরত্ব যেতে সময় লাগে মোটে ৮ মিনিট। লাইনে বাঙালির অভ্যেসমত ঠেলেঠুলে একদম সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম কেবল কারের কাঁচে ঘেরা বাক্সর সামনে জায়গা করে নেবার জন্য। একটু দোল খেয়ে কার যখন চড়া শুরু করলো তখন বেশ উত্তেজনা বোধ করছিলাম, ৫০মি নাগাদ যাবার পর যখন সেটা পুরো গতিতে চলতে শুরু করলো হঠাৎ খেয়াল হলো মাটি থেকে প্রায় ৫ তলা উঁচুতে রোপওয়ে চলছে, দড়ি ছিঁড়ে গেলে সাথে সাথে ভবলীলা সাঙ্গ । তার ওপর প্রতিটা টাওয়ার ক্রস করার পর ফিজিক্সের নিয়ম মেনে কেবল লাইনটা খানিকটা নিচে নেমে আসে আবার ওপরের দিকে যাবার আগে, সেই সময়টা মনে হয় যেন কারটা নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে। যাহোক, রাস্তার মাঝামাঝি সেই খাড়া চড়াই শেষ হলো, সামনে দাঁড়ানোর সুফল এতক্ষণে পাওয়া গেল, সামনে তেইদের শৃঙ্গ সমস্ত জানলা জুড়ে। ঠিক ৮ মিনিটের মাথায় কার থামল ওপর প্রান্তে। পুয়ের্তো দে লা ক্রুজ ছাড়ার সময় তাপমাত্রা ছিল ২৮, এই ৩৬০০মি উঁচুতে সেটা দাঁড়িয়েছে ৮ ডিগ্রী। বাইরে বেরিয়ে তেইদের দিকে তাকিয়ে মনটা উদাস হয়ে গেল। উত্তরবঙ্গে কলেজে থাকার সময় পাহাড়ে যেত বন্ধুরা কিন্তু আমার সেরকম পাহাড় চড়ার অভিজ্ঞতা হয়নি। এতদিন বাদে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি স্পেনের শীর্ষতম শৃঙ্গের প্রায় চূড়ায়, মাঝের পনের বছরে জীবন বদলে গিয়েছে বেশ। আর সেই মুহুর্তে এখানেও আমি একেবারে একা, এই অসাধারণ অভিজ্ঞতা কেবল আমার মনেই রয়ে যাবে, খানকয় ছবি থাকবে বটে কিন্তু সেই শিহরণ জাগানো মুহুর্তটা ভাগ করে নেয়া যাবেনা আর কারো সাথে। এসব ভেবে তাড়াতাড়ি আবার নিচে ফেরত যাব ঠিক করে খানিকটা দেখে নিলাম যতটা সম্ভব। রোপওয়ের ঘরের বাইরে পাথর কেটে তৈরী করা রাস্তা দুদিকে চলে গেছে দুটো ভিউয়িং পয়েন্টের দিকে। পশ্চিম দিকে গেলে দেখা যাবে আর একটা মৃত আগ্নেয়গিরি পিকো বিয়েখো (Pico Viejo), আর পূর্বদিকের পথের শেষে দেখা যাবে পুরো উত্তর দিকের ভূমিরূপ, কালো লাভা, মন্তে ব্লানকো পাইন অরণ্য ওরোতাবা উপত্যকা। আর এই দুই রাস্তার মাঝে ধাপে ধাপে কাটা পাথরের পায়ে হাঁটা পথ উঠে গেছে তেইদের শিখরে যেখান থেকে নাকি বাকি ছটা ক্যানারী দ্বীপপুঞ্জের দ্বীপই দেখা যায়। ট্র্যাভেল গাইড বলছে তেইদের চুড়ায় গেলে রাতটা সেখানেই কাটাতে তাহলে সকালে সূর্য ওঠার সময় এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা দেখা যায় যখন তেইদের তিনকোণা ছায়া ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে দুর থেকে দুরান্তে। এই ভরা দুপুরেও রোপওয়ের এই প্রান্ত থেকে সামনের দৃশ্যের বর্ণনা করা সাধ্যের বাইরে। উত্তর দিকে সমস্তটা জুড়ে তেইদে পর্বত পড়ন্ত রোদে ঝলমল করছে। নিচের দিকে খালি দক্ষিণ দিকটাই ভালো করে দেখা যাচ্ছে, সেদিকে যতদুরে চোখ যায় পাহাড় আর পাহাড় যেন ধাপে ধাপে নেমে যাচ্ছে অতলান্তিক মহাসাগরের বুকে। একটা নতুন শব্দের সাথে প্রথম পরিচয় হলো এই সময়। টিকিট কাউন্টারে দেখছিলাম লেখা আছে "Visibility limited due to Calima", এই কালিমা হলো গরম হাওয়া, নিচের দিকের পাথর গরম হয়ে সৃষ্টি এই কালিমার দরুন সামনের দৃশ্য অনেকটাই আবছা, অনেকটা যেন কুয়াশার বিপরীত। পায়ে হাঁটা রাস্তার দুদিকেই বড় বড় পাথরের স্তুপ, বাতাসে গন্ধকের চড়া গন্ধ, পৃথিবীর কেন্দ্রের সেই গলন্ত লাভায় মিশে থাকা গন্ধক পাথরে পরিনত হয়েছে। সামনের তিনটে পথের কোনটাতেই যাবার সময় বা অনুমতি নেই কাজেই আবার দাঁড়িয়ে পরলাম নিচে ফিরে আসার লাইনে, এবারো জানলার সামনের দিকে, তবে দক্ষিণে যেদিকে নামব সেদিকে মুখ করে। পায়ের নিচে পড়ে রয়েছে ১০০০মি পাহাড়। গায়ে কাঁটা দেয়া দৃশ্য আর পায়ের তলার আপাত ভারহীনতায় ভরা ৮ মিনিটে সেই দুরত্ব অতিক্রম করে আবার যাত্রা শুরু হলো দিনের শেষ গন্তব্যে, লস রোকেস দে গার্সিয়া (Los roques de García) আর য়ানো/যানো দে উকাঙ্কা (Llano de Ucanca), তেইদের কারপার্ক থেকে মাত্র পাঁচ মিনিট দুরে।
তেইদের চূড়া রোপওয়ের ওপরের প্রান্ত থেকে 
কেবল কার আর নিচের লাভায় তৈরী ভূমিরূপ 
তেইদের কার পার্ক থেকে পরের আকর্ষণ অনেকে হেঁটেও যায়, গাড়ি চলা রাস্তার থেকে দুরে একটা হাঁটাপথ আছে তেইদের পাদদেশের পাথুরে সমতলের মধ্যে দিয়ে। রাস্তার বাঁদিকে পারাদোরেস বটে একটা হোটেল, এমন অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে অবস্থিত এই হোটেলে রুমের চাহিদা বলাই বাহুল্য অশেষ, বিশেষ করে পর্বতারোহী হাইকারদের কাছে তেইদে আর তার চারপাশের এলাকা যখন স্বর্গোদ্যানের সমান। আসল চমক তবে রাস্তার ডানদিকে। মেন রাস্তা থেকে বাঁক নিয়ে এখানে রাস্তার দুপাশে গাড়ি রাখার জায়গা। ১০০-১৫০মি দৈর্ঘ্যের সেই রাস্তার শেষে এক ভিউয়িং পয়েন্ট। ডানদিকে উঁচিয়ে থাকা পাথরের স্তুপের পোষাকী নাম লস রোকেস দে গার্সিয়া। কেউ কেউ আবার বলে লা রুলেতা। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, গড়িয়ে আসা বিকেলের সূর্যের আলোয় এই পাথরের স্তুপের সৌন্দর্য অসামান্য। আগ্নেয় শিলার এই স্তুপের পরতে পরতে বিচিত্র সব রঙের খেলা। একদম ডানদিকে, তেইদের চুড়াকে পেছনে রেখে দাঁড়িয়ে আছে প্রবাদপ্রতিম এক প্রাকৃতিক শিলারূপ, তেইদে ন্যাশনাল পার্কের যে কোনো বর্ণনায় যার ছবি বা উল্লেখ পাওয়া যায়। পাথরের এই রাশির আকার অনেকটা উল্টোনো কমার মত, হাজার হাজার বছরের প্রাকৃতিক অবক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট এই অবয়ব যে কোনো ভাস্করের কৃতির সাথে পাল্লা দিতে পারে। পাশের পাথরের ঢিবির ওপর চড়ার ছোট ছোট ধাপ রয়েছে, কিছুটা ওপরে উঠতে পারলে চারদিকের দৃশ্য মন ভরিয়ে দেয়। উত্তরে শুকনো জমিতে বেড়ে ওঠা ঘাস আর ছোট ছোট ঝোপে ঢাকা সমতলভূমি চলে গিয়েছে তেইদের পাদদেশ অবধি। খানিকটা পশ্চিমে দেখলে রয়েছে পিকো বিয়েখো, আর দক্ষিণ পূর্বে অবস্থান করছে মন্তে গুয়াখারা (Mt Guajara)। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে দক্ষিনে তাকালে সামনের দৃশ্য অতিপ্রাকৃত। গুয়াখারার পেছন থেকে পর্বতের সারি বিস্তৃত পুরো দক্ষিন আর দক্ষিন পূর্ব দিক জুড়ে। তবে সেই পর্বত আর ভিউয়িং পয়েন্টের মাঝে ছেয়ে রয়েছে এক সুবিশাল সমতল ভূমি যার নাম য়ানো (স্পেনীয় উচ্চারণ) বা যানো (দঃ আমেরিকা) দে উকাঙ্কা।  রাস্তার উল্টোদিকে পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে সিঁড়ি তৈরী ভিউয়িং পয়েন্ট লস আজুলেখোস (Los Azulejos) যেখান থেকে উকাঙ্কা সমতলভূমিকে খানিকটা ওপর থেকে আরো ভালো করে দেখা যায়। ধু ধু করা সেই জমির থেকে উঠে আসছে হালকা কালিমা, মাঝে মধ্যে লাভাস্রোতে তৈরী বিচিত্র সব ঢেউ খেলানো আকার আর আগ্নেয় শিলারূপ - এসবের সমষ্টিতে তৈরী সুররিয়াল দৃশ্যকল্পের জন্য উকাঙ্কাকে মঙ্গল গ্রহের ভূমিরূপের সাথে তুলনা করা হয়। মন বিহ্বল হয়ে যায় এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে, মনে পড়ে যায় "মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকালমাঝে ..." 
রোকেস দে গার্সিয়ার শিলাস্তুপ 
রোকেস দে গার্সিয়া / লা রুলেতা আর পেছনে তেইদে পর্বত 
য়ানো/যানো দে উকাঙ্কা (উকাঙ্কা সমভূমি)
সম্বিত ফিরে আসে জেনিফারের ফোন সোফিয়ার জলের কাপে পড়ে যাওয়ায়। এবার ফেরার পালা, মন যদিও চায় এই বিশালতার মাঝে দাঁড়িয়ে নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করতে। ফেরার পথে আর দাঁড়ানো নয়, সোজা পুয়ের্তো দে লা ক্রুজ। দেখা হলনা অনেক কিছুই —তেইদের জ্বালামুখ, ভোরের সেই ত্রিভুজ ছায়া, স্পেনের সর্বোচ্চ গ্রাম বিলাফ্লোর (Vilaflor), গুয়াখারার বিপরীত ঢালে অবস্তিত পাইসাখে লুনার (Paisaje Lunar) বা চান্দ্রেয় ভূমিরূপ, তেইদে থেকে রাতের আকাশ - তবে সেসব তোলা রইলো ভবিষ্যতের জন্য, সোফিয়া একটু বড় হলে আবার আসা যাবেখন। ফেরার পথ যদিও একই রাস্তা, দুরত্ব মনে হচ্ছে যেন তিনগুন, আর উৎরাইতে গাড়ি চালানোও কঠিন। পাইন অরণ্য ছাড়িয়ে আগুয়ামান্সার কাছে আবার এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। ওরোতাবা উপত্যকার গা ঘেঁষে নেমে আসা রাস্তা তখন মেঘে ঢাকা। ফগ লাইট জ্বালাতে হলো গাড়িতে, এরকম চলল বেশ কিছু মাইল প্রায় খোদ ওরোতাবা শহর অবধি। ততক্ষণে পাহাড়ের গা জুড়ে লেগে থাকা মেঘের দেয়ালের ওপর থেকে নিচ পুরোটাই ছাড়িয়ে নিচে দেখা যাচ্ছে মেঘে ঢাকা পুয়ের্তো দে লা ক্রুজ। প্লেনে চড়ার সময় এরকম অনুভূতি হয় জানি যেখানে মেঘের নিচে অন্ধকার অথচ ওপরে সব পরিস্কার, কিন্তু রাস্তাতেও যে এরকম ঘটনার সাক্ষী হতে হবে কখনো ভাবিনি। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতামনা যে মেঘে ঢাকা বিমর্ষ করে দেয়া সেই বিকেলে মেঘের সীমানা ছাড়িয়ে এমন জায়গাও আছে ওপরের দিকে যেখানে আকাশ নীলে নীলাকার, সেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা খুঁজলেও এক টুকরো মেঘ চোখে পড়বেনা।  একটা দার্শনিক উপলব্ধি হল যে এই ধারনাটা আমরা আমাদের জীবনেও প্রয়োগ করতে পারি - যখন পরিস্থিতি প্রতিকুল, মন বিষন্ন তখন এই বিকেলটার কথা মনে করে মনকে বলা যেতেই পারে যে ওপরের ওই মেঘের রাশি, জীবন সেখানেই সীমিত নয়, প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে মাথা তুলে মেঘের ওপারে তাকালেই সেখানে তখন ঝলমলে এক দিন, নীল আকাশ বিরাজ করছে। খালি মনে বিশ্বাস বজায় রাখতে হবে যে সেটা সম্ভব।

যখন এই লেখাটা লিখতে বসেছি প্রায় দুসপ্তা সময় পার হয়ে গেছে। জীবন ফিরে এসেছে আবার সেই গতানুগতিকে - অফিসের চাপ, আর্থিক চিন্তা, সাংসারিক টানাপোড়েন জীবনকে আবার গ্রাস করে নিয়েছে। কিন্তু মনের মধ্যে রয়ে গেছে সূর্যালোকে ঝলমল করা উষ্ণ তেনেরিফের দিনগুলো বিশেষ করে সেই ৫ই অক্টোবরের স্মৃতি।  সেখান এখনো অমলিন হয়ে বিরাজ করছে তেইদের অভ্রংলীহ চূড়া, কেবল কারের রোমহর্ষক যাত্রা, উকাঙ্কার অপ্রাকৃত ভূমিরূপ আর রোকেস দে গার্সিয়ার অনবদ্য শিলারূপগুলো। সেই স্মৃতিগুলো যা মনে করিয়ে দেবে যে দৈনিক টানাপোড়েনের শেষে আবার এসে যাবে একটা ছুটি, আবার একটা হাতছানি পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে লুকিয়ে থাকা অন্য কোনো অপার্থিব অভিজ্ঞতার। এখনো অনেক দেরী তার তবে এক এক দিন করে ঠিকই কেটে যাবে একটা গোটা বছর, ততদিন তো রইলই তেইদের সঙ্গ…

পরিশেষ: সাধারণত ভ্রমনের অভিজ্ঞতা আমি লিখি ডায়েরিতে, খুব কম লেখাই আছে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে। বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপে ক্যানারী দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে অনেকেই জানে আর  আসাটা খুবই প্রচলিত। অন্যদিকে বাঙালী সমাজে ইউরোপ বেড়ানোর চল মুদ্রাহারের তারতম্যের জন্য বেশ বিরল, তবু স্বচ্ছল পরিবারের মানুষরা বেড়াতে যায় সাধারণত আর পাঁচটা দর্শনীয় জায়গা বলে আমরা যেগুলো সারা জীবন জেনে এসেছি, যেমন লন্ডন, প্যারিস, দক্ষিন ফ্রান্স, ইতালি গ্রীস সুইজারল্যান্ড। স্পেন বেড়ানোর তেমন চল যে আছে তা দেখিনি, আর থাকলেও সেটা মূল ভূখন্ডেই সীমাবদ্ধ মাদ্রিদ, সেবিলা, বার্সেলোনা, মালাগা। সুদুর অতলান্তিকের ক্যানারী দ্বীপপুঞ্জে বাঙালি পর্যটক আশা করাটা দুষ্কর আর অভিজ্ঞতাও সেটাই দেখালো। ভারতীয় টুরিস্ট একজনও দেখেছি বলে মনে করতে পারছিনা। কিছু ভারতীয় বংশোদ্ভূত পরিবার থাকে তেনেরিফেতে, পেশায় মূলত ব্যবসায়ী কিন্তু সেই অবধিই। বাঙালীদের সাথে সাক্ষাত হয়নি বললে ভুল হবে। ইংল্যান্ডের মত অসংখ্য না হলেও তেনেরিফেতে গোটাকয় ভারতীয় রেস্তোরাঁ আছে যেগুলো চালায় সিলেটি বাংলাদেশীরা। বাঙলার সাথে ওটুকুই যা যোগাযোগ। সে কথা ভেবেই এ লেখার অবতারণা যাতে অতলান্তিক মহাসাগরের বুকে আগ্নেয় পর্বতে ঘেরা সেই তেনেরিফের একটা চিত্র তুলে ধরা যায় বাঙালিদের কাছে। 

Monday, 12 October 2015

ক্রস কানেকশান: একটি রহস্য নাটিকা

সে একটা নাটক শুনেছিলাম বটে একদিন। তখন বাড়িতে টিভি আসেনি আর তেমন বড় হইনি যখন বন্ধুদের সাথে ছুটির দিন পাড়ায় টো টো করে ঘুরবো। রবিবারগুলো কাটত হয় যোধপুর পার্কে মামার বাড়ি জেঠুর বাড়িতে নাহয় সকালে পাড়ায় পাশের বাড়ি মহাভারত দেখে ১১টা থেকে খানিক আড্ডা মেরে বা ক্রিকেট খেলে ১টায় বাড়ি তারপর চান খাওয়া সেরে রেডিও খোলা। কোন কোন রোববার সারা সকালটাই রেডিও শুনে কাটত। শুধু কানে শুনে সব ব্যাপারগুলো বোঝার চেষ্টা করার জন্য কল্পনাশক্তি অনেক জোরালো ছিল — পুরো ঘটনাগুলো চোখের সামনে ঘটতে দেখতে পেতাম। এরকম এক রবিবার দুপুরে খুব সম্ভব ২টো ৪৫য়ে কলকাতা ক'য়ে একখানা নাটক শুরু হল। পঁচিশ বছরেরও আগে শোনা সেই নাটকের কথা ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। কার লেখা কে মুল চরিত্রায়ন করেছিল সেসব একদম মনে নেই তবে সেই নাটকের ছায়া অনুসরন করে এই নাটিকা লেখার প্রচেষ্টা। একটাই অঙ্ক দৃশ্যও ধরতে গেলে একটাই। 

স্থান: লেকের উল্টোদিকে এক ফ্ল্যাটবাড়ি।  
সময়: আশির দশকের শেষের দিকে জানুয়ারি মাস রবিবার দুপুর দুটো 

শ্রীমতি সরকার খবরের কাগজ পড়ছেন বারান্দায় বসে, বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। বিধবা, একাই থাকেন এই বহুতল ফ্ল্যাটে। ছেলে সংসার নিয়ে বিদেশে। এক কাজের লোক আসে লক্ষ্মীকান্তপুরের দিক থেকে সে এখন দু সপ্তার ছুটি নিয়ে দেশে। এই কদিন তাই রান্নাটা নিজেকেই করতে হচ্ছে শ্রীমতি সরকারকে। সকাল থেকে ঝাড়পোঁছ শেষ করে দুপুরের খাওয়াটা সেরে সবে বসেছেন আনন্দবাজারটা নিয়ে। ছেলের ফোন করার কথা কিন্তু কদিন থেকে ফোনটা যা ঝামেলা করছে এক্সচেঞ্জ একদিন ঠিক থাকে তো দুদিন ডাউন। কাগজের ভেতরের পাতায় এক বাড়িওয়ালার খুনের খবর বেরিয়েছে। 

শ্রীমতি সরকার (স্বগতঃ) : আবার একটা খুন! কি দিনকাল পড়েছে কাউকে বিশ্বাস করা যায়না। শেষে বিশ বছরের পুরনো কাজের লোক এভাবে ধোঁকা দিল? নাঃ পাহারাদার রাখার প্রস্তাবটা ভেবে দেখতে হচ্ছে ফ্ল্যাটের সবাই টাকা দিলে কত আর লাগবে? স্বস্তিতে থাকা যাবে অন্তত। দেখি ডায়াল টোনটা এলো কিনা যা ভোগাচ্ছে এ কদিন। 

(শ্রীমতি সরকার বসার ঘরে গিয়ে কাঠের দেয়াল ইউনিটে ঢাউস রঙিন টিভির পাশে রাখা ফোনের রিসিভারটা তুললেন। ডায়ালটোন পাওয়া গেছে)

শ্রীমতি সরকার (স্বঃ) : এই তো কাজ করছে! ছেলেটা ফোন করলে হয় আবার বিগড়ে যাবার আগে। দেখি মৌসুমীকে ফোন করি অনেকদিন আসেনি এদিকে। 

মৌসুমী শ্রীমতি সরকারের ভাইঝি। ঢাকুরিয়ায় বাড়ি মাঝে মধ্যেই এসে দেখা করে যায় পিসির সাথে। 

(ফোনে হঠাৎ এক পুরুষকন্ঠের স্বর ভেসে এলো।  রুক্ষ কর্কশ গলা। বেশ শাসানোর স্বরে আর কাউকে কিছু বলছে। ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা কি কথা হচ্ছে। আবার শোনা গেল দ্বিতীয় এক কন্ঠ।)

শ্রীমতি সরকার : (স্বঃ) উফ আর পারা গেলনা। ভাবলাম ফোন টা ঠিক হয়েছে তা না আবার ক্রস কানেকশন। 
শ্রীমতি সরকার : এই যে ভাই এটা ক্রস কানেকশন হয়েছে আপনাদের আবার ফোন করতে হবে।  

প্রথম কন্ঠ : এই দাঁড়া তো! শুনতে পেলি কারো গলা?
দ্বিতীয় কন্ঠ : না বস লাইনটা গড়বড় করছে বহুত। তুমি বলো। 

(এবার গলা দুটো অনেক স্পষ্ট। শ্রীমতি সরকার দুটো কথাই শুনতে পেলেন।)

শ্রীমতি সরকার : (একটু জোরেই) ক্রস কানেকশন ভাই, শুনতে পাচ্ছেন? 

শ্রীমতি সরকারের কথার মাঝেই প্রথম কন্ঠ আবার কথা শুরু করে দিল।  বেশ জোরালো গলা, শুনে মনে হয় লোকজনকে হুকুম করে করে অভ্যস্ত। 

প্রথম কন্ঠ : তুই সাবধানে কাজ শেষ করবি লোকজন যেন টের না পায়।  কাজ হাসিল করে কদিন গায়েব হয়ে যেতে হবে তোকে। টাকার চিন্তা করিসনা আমি রেখে আসব গনেশের কাছে। পুলিশ যেন একদম সন্দেহ না করে।  

পুলিশের কথায় মিসেস সরকারের একটু আগ্রহ জাগলো। চুপ করে শুনতে লাগলেন কি বলছে লোকদুটো।  কথাবার্তার ভাবগতিক মোটেও ভালো ঠেকলনা শ্রীমতি সরকারের। 

প্রথম কন্ঠ: আমি কভার করব তোকে ভয় নেই।  আমি রাস্তায় দাঁড়াবো কান খাড়া রাখিস বেগতিক দেখলেই সিটি মারব সাথেসাথে বেরিয়ে আসবি কিন্তু দৌড়োবিনা।  এমনিতে এই সময় সাদার্ন অ্যাভিনিউ ফাঁকাই থাকে চুপচাপ কাজ গুটিয়ে বিকেল গড়ানোর আগেই কেটে পড়তে হবে।  
দ্বিতীয় কন্ঠ: গুরু খবর পাকা তো শুধুমুধু হানা মেরে খালি হাতে ফিরতে হবেনা তো?
প্রথম কন্ঠ: সেসব নিয়ে চিন্তা করিসনা খবর একদম পাকা। তুই শুধু যা করতে বলেছি ঠান্ডা মাথায় সেরে ফেলবি, কথার নড়চড় হবেনা আমার ষাট তোর চল্লিশ। 

শ্রীমতি সরকারের উৎকন্ঠা বেড়ে গেল।  লোকগুলো তো অবশ্যই কোনো বদ মতলব আঁটছে। ঠিক করলেন খানিকক্ষণ শুনবেন কি বৃত্তান্ত তারপর পুলিশকে ফোন করা যাবেখন। চুপ করে শুনতে লাগলেন। 

দ্বিতীয় কন্ঠ: বস সাবাড় করতেই হবে না মুখ চোখ বেঁধে ফেলে আসবো?
প্রথম কন্ঠ: এই হারামি এতবার করে বললাম শেষে তুই এই বুঝলি? সালা জানে না মারলে পুলিশ তো আসবে, তোকে কিরম দেখতে তার ছবিও একটা বানাবে, তারপর তোর্ ধরা পড়তে আর কতদিন? ছেনালীপনা বন্ধ কর, ফ্ল্যাটে ঢুকবি মুখ চেপে ধরে বাঁধবি চিল্লাতে না পারে মত তারপর মাল হাতিয়ে মালিককে সাবাড় করবি। যতদিনে পুলিশ বা পড়শি দরজা ভেঙ্গে ঢুকবে ততদিনে সব সোনা গালিয়ে বাজারে চালান হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় কন্ঠ: আরে দাদা রেগে যাচ্ছ কেনো? কোনো চিন্তা নেই একলা মানুষ তো আরামসে কাজ হয়ে যাবে। সেই বেলেঘাটার বুড়োটার মত তো আর হবেনা। 

ফোনটা আবার গন্ডগোল করছে। লাইনে কড়কড় আওয়াজ আসছে।

প্রথম কন্ঠ: নে নে ... দেরী করিসনা। সবকিছু ... ... ... নিয়েছিস তো? 
দ্বিতীয় কন্ঠ: হ্যাঁ সব আছে ওস্তাদ। ফ্ল্যাটের চাবি যন্তর … …
প্রথম কন্ঠ: ঠিকানা মনে … …
দ্বিতীয় কন্ঠ: হ্যাঁ হ্যাঁ বস একশো … … দার্ন অ্যাভিনি… সব আমার এলাকা চোখ বন্ধ …… যেতে পারি। 
প্রথম কন্ঠ: নে নে আর ক্যালি … … হবেনা। ঠিক তিন … … বাড়ির পাশের … রোডে  আমি দাঁড়িয়ে … …
দ্বিতীয় কন্ঠ: ঠিক আছে গুরু … …

(লাইন কেটে গেল। খালি মিসেস সরকারের ফোন তখনো কড়কড় করছে। রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন)

শ্রীমতি সরকারের মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরছে। চোখে মুখে আতঙ্ক। একে প্রেসারের রোগী তার ওপর হঠাৎ করে এমন এক ভয়ঙ্কর খবর।  নম্বরটা শুনতে পেলেননা ফোনে কিন্তু শ্রীমতি সরকারের বাড়ির নম্বর একশ তিরাশি, তার মানে বাড়ির কাছাকাছিই। কি করবেন ঠিক করে উঠতে পারছেননা। লোকটা বলল বিকেলের মধ্যে কাজ সারবে তার মানে এক দেড় ঘন্টার মধ্যে বাড়ির কাছাকাছি একটা খুন বা ডাকাতি ঘটবে। 

(দেয়াল ইউনিট ধরে দাঁড়ালেন খানিকক্ষণ। ধাতস্থ হয়ে গেলাসে জল ঢেলে খেলেন অল্প একটু)

শ্রীমতি সরকার (স্বঃ): কি সাংঘাতিক। ঘরের দোরগোড়ায় খুন! এ হতে দেয়া যায়না। 

(ফোন ডায়াল করলেন থানায়)

শ্রীমতি সরকার: হ্যালো, লেক থানা? 
পুলিশ অফিসার: বলছি। আপনার নাম?
শ্রীমতি সরকার: আমার নাম বসুন্ধরা সরকার, একটা খুব জরুরি খবর আছে। 
পুলিশ অফিসার: কি ব্যাপার বলুন। 
শ্রীমতি সরকার: আমি এইমাত্র ফোনে ক্রস কানেকশন হয়ে দুজন লোকের কথা শুনতে পেলাম। তারা সাদার্ন অ্যাভেনিউর এক ফ্ল্যাটে ডাকাতি আর মালিককে খুনের ফন্দি করেছে।  
পুলিশ অফিসার: ইন্টারেস্টিং, একটু খুলে বলুন ক্রস কানেকশন কিকরে হলো?
শ্রীমতি সরকার: আমাদের এক্সচেঞ্জটা কাজ করছেনা কয়েকদিন, ফোনে প্রায়ই গন্ডগোল। এখুনি ডায়ালটোন খুঁজতে গিয়ে গলা দুটো শুনতে পেলাম। আজ দুপুরে তারা কোনো একটা বাড়ি ঢুকে মালিককে খুন করে বাড়ির সব সম্পত্তি হাতানোর কথা বলছিল।  
পুলিশ অফিসার: এই বললেন ফ্ল্যাট আবার বলছেন বাড়ি ঠিক কি বলল লোকগুলো?
শ্রীমতি সরকার: না না ফ্ল্যাটই বলল।   
পুলিশ অফিসার: আচ্ছা। লোকগুলোর নাম শুনতে পেলেন?
শ্রীমতি সরকার: না তবে একজন ভারি গলা আর অন্যজন একটু কম বয়েসের মনে হয়।  ভারী গলা মনে হয় প্ল্যান করছে সব।
পুলিশ অফিসার: কোন বাড়ি, কি নাম কিছু শুনতে পেলেন?
শ্রীমতি সরকার: না না লাইনটা আবার বিগড়ে গেল যে।  বলল একশ কিছু একটা, সাদার্ন অ্যাভিনিউই মনে হয় বলল, ঠিক শুনতে পেলামনা।
পুলিশ অফিসার: ম্যাডাম ঠিক শুনেছেন তো, এই তো বললেন আদ্ধেক শুনতে পাননি। 
শ্রীমতি সরকার: না প্রথম দিকে তো ক্লিয়ারই ছিল।  দেখুন আপনারা তাড়াতাড়ি কিছু করুন দয়া করে, এরা তো খুনের কথা বলছে। 
পুলিশ অফিসার: আচ্ছা আচ্ছা দাঁড়ান ওসির সাথে কথা বলে দেখি। লাইনে থাকুন।
শ্রীমতি সরকার: আচ্ছা।

শ্রীমতি সরকার অধৈর্য্য হয়ে উঠলেন কিন্তু আর যে কি করবেন ভেবে পাচ্ছেননা। প্রায় পাঁচ মিনিট কেটে গেল পুলিশের সাড়াশব্দ নেই। 

(ফোনের রিসিভারটা ধরে অস্থির পায়ে খানিক হাঁটতে শুরু করলেন। পুলিশ অফিসারের গলা শুনতে পাওয়া গেল আরো ২-৩ মিনিট পর। 

পুলিশ অফিসার: ম্যাডাম আচ্ছেন নাকি লাইনে?
শ্রীমতি সরকার: হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন। কি বললেন ওসি?
পুলিশ অফিসার: দেখুন ম্যাডাম আপনি তো ঠিকঠাক কোনো ইনফরমেশনই দিতে পারছেননা। ঠিকানা শুনতে পাননি, ফ্ল্যাটের নম্বর ঠিক জানেননা, মালিকের নাম শোনেননি, কোন ভরসায় তদন্ত করা শুরু করি বলুন তো?
শ্রীমতি সরকার: যা যা শুনলাম বললাম তো আপনাকে। 
পুলিশ অফিসার: দেখুন অপরাধ নেবেননা। হয়ত কেউ ফোনে মস্করা করেছে সেটাও তো হতে পারে?
শ্রীমতি সরকার: একদন না, যেভাবে লোকগুলো কথা বলছিল...
পুলিশ অফিসার: তাতে কিছুই প্রমান হয়না। আপনার বাড়ির নম্বরটা কি যেন বললেন?
শ্রীমতি সরকার: একশ তিরাশি। ছতলায় ফ্ল্যাট এগারো।
পুলিশ অফিসার: দেখুন ওদিকটা তো গোলপার্ক থানা, আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে। আপনি বরং গোলপার্ক থানায় একটা ফোন করুন।
শ্রীমতি সরকার: কি আশ্চর্য মানুষের জীবনমরণ সমস্যা আর আপনারা এলাকা দেখাচ্ছেন?
পুলিশ অফিসার: দেখুন আপনার দেয়া তথ্যে কাজ করা যায়না। তাছাড়া রোববারের বাজার থানায় লোকই নেই যে টহলে পাঠানো যাবে। গোলপার্ক থানায় করুন ওরা কিছু করতে পারে কিনা দেখুন। আচ্ছা ধন্যবাদ।

(কিছু বলার আগেই ফোন কেটে গেল কট করে।) 

শ্রীমতি সরকার: হ্যালো হ্যালো?...কি ছোটলোক!

শ্রীমতি সরকার খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন রিসিভারটার দিকে, যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেননা যে পুলিশ অমনভাবে লাইন কেটে দিতে পারে।

(এই সময় আড়াইটের ঘন্টা বাজলো দেয়াল ঘড়িতে ঢং করে। খানিকটা চমকে উঠে ঘড়ির দিকে দেখলেন শ্রীমতি সরকার।)

শ্রীমতি সরকার: (স্বঃ) আড়াইটে বেজে গেলো? গোলপার্কের পুলিশগুলোও এরকমই হবে নাতো? দেখা যাক। 

(ডাইরেক্টরি খুঁজে গোলপার্ক থানার নাম্বার যোগাড় করে ডায়াল করলেন)

পুলিশকন্ঠ: গোলপার্ক থানা এসি সুমন আচার্য বলছি। 
শ্রীমতি সরকার: হ্যালো আমার নাম বসুন্ধরা সরকার। খুব জরুরী ব্যাপার। 
এসি: বলুন মিসেস সরকার কী সাহায্য করতে পারি?
শ্রীমতি সরকার: একটু আগে আমার ফোনে ক্রস কানেকশন হয়ে গিয়েছিল। দুজন লোক সেখানে কাউকে খুন করে তাদের ফ্ল্যাটে ডাকাতি করার প্ল্যান করছিল। আজ দুপুরেই কাজ সারবে বলছিল। আমি লেক থানায় ফোন করলাম ওরা বলল কিছু করতে পারবেনা আপনাদের থানায় ফোন করতে হবে। তাড়াতাড়ি কিছু করুন। 
এসি: হ্যাঁ লেক থানার একটু দুর্নাম আছে এ ব্যাপারে আমাদের থানায় কেস দায়ের করানোর। খুলে বলুন একটু কি শুনেছেন ক্রস কানেকশানে?
শ্রীমতি সরকার : দুজন লোক কথা বলছিল, একজন মনে হয় আসল মাথা অন্যজন অর্ডার নিচ্ছিল কি করতে হবে।  সাদার্ন অ্যাভিনিউর একশ কিছু নাম্বারের বাড়িতে ডাকাতি করবে, মালিককে মেরে ফেলে বাড়িতে সোনাদানা লুঠ করবে। 
এসি : হুম এতো বেশ সিরিয়াস ব্যাপার। লোকগুলোর গলা শুনলে চিনতে পারবেন?
শ্রীমতি সরকার : হ্যাঁ তা ঠিক পারব। কিন্তু লোকগুলো তো বলছিল এই দুপুরেই কাজ সারবে।  আপনি কোনো পুলিশ লাগাতে পারবেন না? পুলিশ দেখলে হয়ত প্ল্যান পাল্টাতে বাধ্য হবে।  
এসি : সে আমরা দেখছি। রবিবারে এমনিতে কম পুলিশ থাকে থানায়, এমার্জেন্সি ছাড়া গাড়ি ইয়ুজ করিনা তবে খুনের ব্যাপার তো সিরিয়াস। আর কোনো ক্লু শুনতে পেলেন? বাড়ির নাম্বার বা নাম?
শ্রীমতি সরকার : নাহ। বাড়ির নাম্বার একশ তারপর কি বলল শুনতে পাইনি ঠিক।  লাইনটা আবার গন্ডগোল করছিল। কিন্তু নাম্বারের পর সাদার্ন অ্যাভিনিউ পরিস্কার শুনলাম। দুজনে বাড়ির পাশের কোন এক রোডে মিট করবে। তবে বলছিল যদ্দিনে পুলিশ ফ্ল্যাটে ঢুকবে সোনাদানা ততদিনে গালিয়ে বাজারে পাচার হয়ে গেছে।  আর যে ডাকাতি করবে সে আগেও অনেক এরকম কাজ করেছে আর খুনও করেছে। যে সাগরেদ সে কদিন গায়েব হয়ে যাবে কিন্তু ভাগ গনেশ বলে কারো কাছে থাকবে। 
এসি : বটে, তাহলে তো পুরনো পাপী। তবে গয়না গালিয়ে বাজারে চালান ক্রিমিনালদের রেগুলার প্রসেস...গনেশ নামটা খতিয়ে দেখতে হবে লোকাল ক্রিমিনাল লিস্টে। 
শ্রীমতি সরকার :  আর হ্যাঁ, বলছিল বেলেঘাটার কোনো বুড়ো নাকি খুব ট্রাবল দিয়েছিল এদের। 
এসি : (চমকে) বেলেঘাটার বুড়ো?!!! আপনি স্পষ্ট শুনেছেন তো?
শ্রীমতি সরকার : হ্যাঁ কেনো এটা কোনো ক্লু বুঝি?
এসি : বেলেঘাটায় রিসেন্টলি একটা নৃশংস খুন হয়।  এক বুড়ো মানুষের ফ্ল্যাটে দুজন লোক ডাকাতি করতে যায়।  ভদ্রলোক এক্স সার্ভিসম্যান, ডাকাতদের বিনা মোকাবিলায় যেতে দেননি। শেষে এত শব্দ হয় যে পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন হাঁক মারতে থাকে, ডাকাত দুজন পালিয়ে যায় কিছু না হাতিয়েই। বৃদ্ধ অনেক ছুরির আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।  কিন্তু সারভাইভ করতে পারেননি শেষ পর্যন্ত। তবে পুলিশকে স্টেটমেন্ট দেন মারা যাবার আগে, আর পাড়ার লোকজনদের কাছে থেকে ডাকাতদের একটা আইডিয়াও পাওয়া যায়।  
শ্রীমতি সরকার : কি সাংঘাতিক!!
এসি : হ্যাঁ। এটা কলকাতা পুলিশের একটা বড় তদন্ত। সব থানাই মোটামুটি জানে কেসটার ব্যাপারে। আপনার তথ্য অনুযায়ী এরাই তাহলে সেই দল মনে হচ্ছে। তবে শুনে তো মনে হচ্ছে শুধু দুজন লোক অপারেট করছে, আমাদের ধারণা ছিল অর্গানাইজড ক্রাইম। কম লোকের গ্যাং ধরা কঠিন। 
শ্রীমতি সরকার : তাহলে তাড়াতাড়ি কিছু করুন। এক দেড়ঘন্টা তো বাড়ি বিকেল হতে।  
এসি : হ্যাঁ হ্যাঁ আমি দেখছি কি করা যায়।  এখুনি টিম তৈরী করছি। আপনি আপনার ডিটেলস গুলো একটু বলুন ডায়রি করার জন্যে।
শ্রীমতি সরকার : লেক থানাকেও তো দিলাম ডিটেলস। শুরু করুন তবে। 
এসি : স্ট্যান্ডার্ড প্রসেস ম্যাডাম। আপনার নামটা আর একবার বলুন। সরকার বললেন তো?
শ্রীমতি সরকার : হ্যাঁ। বসুন্ধরা সরকার।
এসি : বাড়ির ঠিকানা?
শ্রীমতি সরকার : একশ তিরাশি সাদার্ন অ্যাভিনিউ। ছ তলায় ফ্ল্যাট এগারো। 
এসি : ওকে। আর আপনি বলছিলেম যে বাড়িতে ডাকাতি করার প্ল্যান সেটাও একশোর ঘরের নাম্বার?
শ্রীমতি সরকার : হ্যাঁ সেরকমই তো শুনলাম। 
এসি :তাহলে তো আপনার বাড়ির আশেপাশে। ছতলা বললেন না? আপনি আমাদের হেল্প করতে পারেন বারান্দা থেকে সন্দেহজনক কোনো অ্যাকটিভিটি দেখলে পুলিশকে খবর দিতে পারেন।
শ্রীমতি সরকার : ঠিক আছে আমি চোখ রাখবো রাস্তায়। 
এসি : থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। গ্রুপটাকে হাতেনাতে ধরতে পারলে আপনার একটা পুরস্কারও জুটতে পারে দু হাজার টাকা কোলকাতা পুলিশ থেকে। 
শ্রীমতি সরকার : আমার আর এই বয়সে টাকাপয়সার দরকার নেই ভাই। একা থাকি বাড়িতে পাড়ার আশপাশটা যদি নিরাপদ থাকে সেটাই নিশ্চিন্তি। 
এসি : হুঁ। আপনি একা থাকেন তাহলে ফ্ল্যাটে?
শ্রীমতি সরকার : হ্যাঁ একাই আপাতত। কাজের একটা মেয়ে থাকে সারাদিন সে এখন ছুটিতে। 
এসি : ওকে। আপনি যখন একা বাড়িতে একটু এক্সট্রা কেয়ারফুল থাকবেন। নাম না জিগ্যেস করে দরজা খুলবেননা সে যখনই হোক না কেন। 
শ্রীমতি সরকার : আমি খুলিনা বিশেষ করে ইদানীং ফ্ল্যাটে ডাকাতি শুরু হবার পর আরোই না। কাজের মেয়েটাকেও শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছি। 
এসি : এক্সেলেন্ট। আচ্ছা ম্যাডাম আমি অপারেশন চালু করছি। আপনি নজর রাখুন। আচ্ছা ধন্যবাদ। 
শ্রীমতি সরকার : ধন্যবাদ। 

(ফোন কেটে গেল। শ্রীমতি সরকারের ভাবভঙ্গি অনেক আশ্বস্ত। ঘড়ি দেখলেন। তিনটে বাজতে দশ। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন যদি কিছু দেখা যায়।)

(বারান্দার বাইরে শীতের বিকেলের দৃশ্য। পড়ন্ত মিঠে রোদে লেকের জল ঝিলমিল করছে। দুরে বড় লেকে দুটো রোয়িং নৌকো প্র্যাকটিস করছে। রাস্তায় জনমানুষের চিহ্ন নেই। মাঝে হঠাৎ হুশ করে চলে গেল একটা ২২১ গোলপার্কের দিকে। দুরে কোনো মাঠে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে, ভেসে আসছে ব্যাটবলের ঠক ঠক শব্দ আর মাঝেমধ্যে হাউজ্যাট)

শ্রীমতি সরকারের মনটা খারাপ হয়ে গেল। শীতের এ কটা মাসই যা উপভোগ করা যায় গরম আর বৃষ্টি ছাড়া। এ সময়টা তিনি আয়েস করে এককাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসেন, এই নিরিবিলি বিকেলটা এনজয় করেন। কিন্তু এই দিনটা যে একেবারে অন্যরকম। এই অপরূপ শীতের বিকেলের পটভূমিতে ঘটতে চলেছে এক বর্বর হত্যাকাণ্ড। খানিকটা উত্তেজিতও হয়ে উঠলেন যদি সত্যিই পুলিশ ধরতে পারে খুনিগুলোকে। গোয়েন্দা গল্পের তেমন ভক্ত না হলেও লীলা মজুমদারের রোমাঞ্চকর গল্পগুলো মনে পড়ে গেল। কলকাতা পুলিশ কি সত্যি তাঁকে পুরস্কার দেবে?

(আনমনা হয়ে তাকিয়ে ছিলেন শ্রীমতি সরকার, চমক ভাঙলো ঘড়িতে তিনটে বাজতে। রাস্তার দিকে চাইলেন যদি কিছু দেখা যায়। গাছে ঢাকা সাদার্ন অ্যাভিনিউ যেন হলদে পাতার জালে জড়ানো। শ্রীমতি সরকার ব্যালকনি থেকে গোলপার্ক আর স্টেডিয়াম দুদিকেই দেখে নিলেন। রাস্তা যে কে সেই ফাঁকা।)

শ্রীমতি সরকার : (স্বঃ) আর কতক্ষণ যে বাকী! পুলিশের দেখা নেই এখনো। 

(অস্থির হয়ে ঘড়ির দিকে দেখলেন আবার। সবে তিনটে পাঁচ। শ্রীমতি সরকার অপেক্ষা করছেন কখন চারটে বাজবে। স্কুল ছুটি হলেই এদিকটা আবার জমজমাট। গোলপার্কের দিক থেকে একটা ২২১ দাঁড়াল শ্রীমতি সরকারের ফ্ল্যাটবাড়ি ছাড়িয়ে লেক কালীবাড়ি স্টপেজে। 

হঠাৎ চোখে পড়ল ২২১টা যেদিক থেকে এসেছিল সেদিক থেকে একটা সাইকেল আসছে। অন্য দিন হলে ঠাহর করে দেখতেননা কিন্তু আজ ভাল করে দেখতে হবে বলে নজরে রাখলেন। হতেও পারে এই খুনি কিম্বা প্লেন ড্রেসের পুলিশ। সাইকেলটা ডানদিকে ঘুরে কেয়াতলা রোডের দিকে মোড় নিল।)

শ্রীমতি সরকারের বারান্দা থেকে ওদিকটা দেখা যায়না কিন্তু বসার ঘরের অন্য জানলা গিয়ে পুরোটাই চোখে পড়ে। ফ্ল্যাটবাড়িটা দুই রাস্তার কোনে না হলেও কোনের তিনটে বাড়ি দুই আর তিনতলা তাই কেয়াতলা রোডের একটা ফুটপাথ পুরোটাই নজরে আসে। 

(শ্রীমতি সরকার বসার ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মারলেন কেয়াতলা রোডের দিকে। সাইকেলওয়ালা সাইকেল দেয়ালে দাঁড় করিয়ে অন্য একজন লোকের সাথে কথা বলছে। খানিক দুরে এক ফুচকাওয়ালা টিউকল থেকে জল ভরছে। লোকদুটো ফুচকাওয়ালার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে আবার কথা শুরু করল। সাইকেলওয়ালার পরনে চেক শার্ট হাতকাটা সোয়েটার খাকি প্যান্ট হাওয়াই চটি সাইকেলের হাতল থেকে একটা সাদা ব্যাগ ঝুলছে। অন্য লোকটার গায়ে নীল ফুলহাতা সোয়েটার জিনস স্পোর্টস শু অল্প টাক। কথা বলতে বলতে দুজনেই চারপাশের বাড়িগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে নিলো, শ্রীমতি সরকারের ফ্ল্যাটের দিকেও দেখল, শ্রীমতি সরকার ঝট করে সরে এলেন। মনে হয় এতো দুরে দেখতে পায়নি তাঁকে।)

(শ্রীমতি সরকার ফোন তুলে ডায়াল করলেন গোলপার্ক থানা। ডায়াল করে রিসিভারটা কানে তুললেন। ফোন আবার ডেড, কোনো ডায়ালটোন নেই। খালি মাঝেমধ্যে কড়কড় আওয়াজ)

শ্রীমতি সরকার : (স্বঃ) উঃ ঠিক যখ্খুনি দরকার তখনই ফোনটা আবার গেল? কোন কাজে আসেনা ক্যানসেল করে দেব সামনের মাসে। মরতে ক্রস কানেকশানটাই যে কেন হতে হল, কলটা না শুনলে তো পুরো রবিবারের বিকেলটা এমন বরবাদ হতনা। 

(আবার বসার ঘরের জানলা দিয়ে চাইলেন। লোকদুটো গায়েব। ফুচকাওয়ালা জল নিয়ে অনেকটা দুরে এখন। শ্রীমতি সরকারের কেন যেন মনে হচ্ছে ওই দুটো লোকই কালপ্রিট। ঘড়ির দিকে তাকালেন আবার। সময় যেন থেমে গেছে ঘড়িটায়। সোয়া তিনটেও বাজেনি এখনো। পুলিসকে আবার ফোন করার জন্য ফোন তুললেন। ডায়ালটোন নেই। বারান্দায় গিয়ে নিচের দিকে চাইলেন। নীল সোয়েটার সাদার্ন অ্যাভিনিউর ওপারে কেয়াতলা রোডের মোড়ের উল্টোদিকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছে। সাইকেলওয়ালাকে দেখা যাচ্ছেনা)

(গোলপার্কের দিক থেকে হঠাৎ দেখা গেল একটা পুলিশ জিপ। শ্রীমতি সরকার একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।) 

শ্রীমতি সরকার : (স্বঃ) বাঁচাল তবে! এসি লোকটা তাহলে কথা রেখেছে। পুলিসকে এখনো ভরসা করা যায়। অন্য লোকটা কোনদিকে গেল কে জানে। 

(নীল সোয়েটারকে একটু অস্থির দেখাচ্ছে। চট করে সিগারেট ফেলে পকেটে হাত ঢোকালো। পুলিশ গাড়ি কিন্তু  থামলোনা। বরং হুশ করে চলে গেল শরৎ বোস রোডের দিকে। নীল সোয়েটার আবার আরাম করে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। দেখে মনে হচ্ছে লোকটা কেয়াতলা রোডের দিকেই তাকিয়ে আছে। সাইকেলওয়ালা তাহলে ওদিকেই গেছে মনে হয়। শ্রীমতি সরকার অন্য জানলার দিকে গেলেন।)

(কেয়াতলা রোড শুনসান। আরো ভালো করে দেখার জন্য ঝুঁকে দেখলেন জানলা থেকে। নিচে ফ্ল্যাটে ঢোকার মেন বড় গেট। আর একটু মাথাটা বাড়িয়ে দেখলে ফ্ল্যাটবাড়ির কমন উঠোন পেরিয়ে বাড়ির মেন এনট্রান্সটা দেখা যায়। সেদিকে একবার চাইলেন শ্রীমতি সরকার। দেখলেন সাদা ব্যাগ আর হাওয়াই চটি পরা একটা খাকি প্যান্ট পা উধাও হয়ে গেল বাড়ির ভেতরে।)

বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল শ্রীমতি সরকারের। মনে মনে ঝালিয়ে নিলেন লোকগুলো ফোনে যা বলছিল। সাদার্ন অ্যাভিনিউ, কেয়াতলা রোডে দেখা করার কথা, একশো তিরাশির বাড়ি। যে অংশগুলো শুনতে পাননি সেগুলো এখন খাপেখাপে জোড়া লেগে যাচ্ছে। 

(শ্রীমতি সরকার আবার ফোন ট্রাই করলেন। পুলিশ ভ্যানটা খুব বেশীদুর যায়নি হয়ত। রিসিভারে ডায়ালটোন শোনা যাচ্ছে। উদগ্রীব হয়ে সব বলার জন্য তৈরী হঠাৎ শোনা গেল সেই পরিচিত গলা "এই নম্বরটি এখন ব্যস্ত। দয়া করে একটু পর আবার ডায়াল করুন")

(শ্রীমতি সরকার অধৈর্য হয়ে বসার ঘরে পায়চারী করছেন।  আবার বারান্দায় গেলেন। যদি পুলিশ ভ্যান দেখেন চিৎকার করবেন। নীল সোয়েটার তখনো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। ঘড়িটা দেখে নিল একবার তারপর ওপর দিকে চাইল…)

শ্রীমতি সরকার : (স্বঃ) একী এ তো আমারই দিকে দেখছে।  তবে কী…

(লোকটা তাকানো শেষ করে হাঁটা দিল কেয়াতলা রোডের দিকে)

আতঙ্কে শ্রীমতি সরকারের রক্ত জল হয়ে গেল। এতক্ষণ তিনি ক্রস কানেকশানে কথা শুনে বিন্দুমাত্রও ভাবেননি যে এরা তাঁকেই মারার প্ল্যান করছে। খুন রোখার সঙ্কল্পে পুলিসকে ফোন করে রিপোর্ট করতে করতে তিনিও যে তাদের লক্ষ্য হতে পারেন সেটা একবারও ভাবেননি। তবু একবার আবার মনে করার চেষ্টা করলেন চব্বিশ ফ্ল্যাটের বাড়িতে আর কে কে একা থাকে। নীল সোয়েটার হয়ত গেল সাগরেদকে সাবধান করতে। 

(শ্রীমতি সরকারের চিন্তার জাল তছনছ হয়ে গেল পায়ের শব্দে। খুব হাল্কা শব্দ কিন্তু পরিস্কার। সিঁড়ি ভেঙে খসখস আওয়াজটা তাঁর দরজার সামনেই থামল। শুনতে পাচ্ছেন ঠুংঠাং চাপা ধাতব শব্দ।)

নড়াচড়ার কোন শক্তি আর নেই শ্রীমতি সরকারের। শুধু মনে পড়ে গেল তাঁর সব সোনাদানা ব্যাঙ্ক থেকে কদিন আগে তুলে এনেছিলেন অন্য ব্যাঙ্কে রাখবেন বলে, তাঁর নিজের সব গয়না তার ওপর ছেলের বৌয়ের কয়েকটা। মনে পড়ে যাচ্ছে কাজের মেয়ে ভারতীকে বলছেন পরের বার বলবেন ওদের গয়না যেন নিয়ে যায় সাথে করে। একলা মানুষ বাড়িতে, সোনাগয়না রাখা বাড়িতে–আসল টার্গেট যে তিনিই সেটা অনুমান করতে এত সময় লাগল। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। 

শ্রীমতি সরকার : (স্বঃ) না এ হতে পারে না… শেষে কিনা আমিই…(দৌড়ে বারান্দায় গেলেন)…বাঁচাওওও

(শ্রীমতি সরকারের চিৎকার তেমন জোরে শোনা গেলনা। গলা শুকিয়ে কাঠ। দরজার ইয়েল লকটা আস্তে আস্তে ঘুরে গেল। দরজাটা অল্প খুলতে দেখা গেল উল্টোদিকে নব ধরে আছে চেক শার্ট পরা একটা হাত…)

যবনিকা

Monday, 28 September 2015

Viva España: collage of imageries on Spain before first encounter

The idea of Spain did not invoke many imageries when I was a child. Apart from of course the country of bullfight, the Matadors and Spanish Armada. However, my earliest recollection of Spain is a funny fact that came from a general knowledge book - a common sight in eighties' Calcutta, mainly sold by hawkers on footpaths and public transports. Apparently there was a Spanish village, where all the people are born with seven fingers in their hands. In those books, written in Bengali, the name if the village was shown as ফের ভোরা ডিবুই ট্রাগো or "Fer Vora Dibui Trago". I could not check the veracity of this information then, as our mind worked as a dark room putting information away but later in its hard to find them, although they are always there. About thirty years later, searching for this fact showed two references, one in Ripley's believe it or not and another from Berkeley Times in 1929, claiming that there is a Madrid suburb, where people have six or more fingers as norm with five fingers a rarity. Cervera de Buitrago, the township was obviously misinterpreted by the Bengali compiler, but it's amazing how news about a township around Madrid landing up in a general knowledge book in Calcutta many decades later. 

Coming back to the reference to Spain, as I grew up, with the penchant to know about the world we live in, I soaked up all the information in the geography books about Europe, from industrial regions in Ruhr to Steppes in Russia and then about Sevilla steel. In 1992, when I watched my first Olympics I was stunned by Barcelona and how in grandeur and culture it only rivalled Paris. Starting to learn a bit more about sports and especially the fact that football teams show name of the cities, made me aware of some other cities — Valencia, Bilbao, Zaragoza. Other than football, with time I came across names of famous Spaniards from a diverse background and time ranging Cervantes to Pablo Picasso to Arantxa Sanchez Vicario. However, I did not have a complete image of Spain as a country and its culture for a long time, all such previous snippets formed a jumble of jigsaw pieces that needed putting together. 

I read For whom the bell tolls around the year 2000, which gave me a little more insight about Spain, but that was a long time ago and the information somehow was lost in the way. However, the mysteries of Spanish culture slowly started to unfurl through Shakira, when she shook the world with her "whenever wherever". That was in essence my first taste of Spanish language and music, although by then Spanish pop was quite popular in far corners of the world through Enrique Iglesias Ricky Martin and other new talents of the nineties. The songs of Shakira created enough interest in learning about Spanish music and language that made me buy a collection of her Spanish songs. Then in 2008, when I was coming to the UK, I decided to widen my gamut of languages, adding Spanish to the repertoire. And thus began endless nights of staying up at night, chatting with people from Spain and South America, which has given me first ideas of the structures of the language and words. 
Then in 2008 whilst in Cranfield, my next door neighbour Clara took up a job in the community centre as a Spanish teacher and persuaded by her, I decided to join the Spanish class. Also, while listening to Shakira around this time, I came across a band named Amaral, and Miguel Bosé. The growing interest in the language paired with the love for Spanish music gave me a perfect platform to learn more about the country. Since Cranfield, I continued following this newfound passion through listening Spanish music and watching Spanish films.

It made me appreciate Spain as a confluence of different cultures that extended its roots all over the world. How Spain remained, like Turkey, a witness of the coexistence and conflicts of Christian and Islam regimes, how it even stayed under a dictatorship in the twentieth century, how bullfighting is still a popular sport in Spain, and how Spanish economy is on the brink of a meltdown — it paints a grim picture sometimes, but isn't that always the case if we keep aside our nationalistic pride? To me Spain is a country always gleaming in Mediterranean sunshine, the land of Alhambra and Santiago de Compostela, home of tiki-taka football, the country with arid landscape and gateway to Africa. Spain is the land of Paella, of colourful food but without being spicy, it is the ritualistic tomato-throwing in La Tomatina, the ideological debate between Madrid and Barcelona. But above all, it is the home of the fiery Spanish language, which is extended from literature to music to performance arts like dance, films, theatre and form the very core of the Spanish life and existence.

I didn't intend to write a treatise on every country I plan to visit. My travelogues will serve that purpose. This is an exception that occured to me, while we were planning the places to see on our Spanish holiday in October. Looking at the volcanic Canary isles, their famous lunar landscape and surroundings of deep blue Atlantic ocean in the Google StreetView reminded me that there is Spain beyond the European mainland, but the spirit is still unmissable, and the sun pours out its unabashed rays of golden sun all round the year — a far cry in the UK near arctic circle. The expectations of a great holiday in the glorious sun made me reflect how well that picture blended with my imageries of Spain. From a fun fact of people having seven fingers, past thirty years have added many pieces of the conundrum, and finally setting foot on the Spanish soil will be a giant step in bringing all such snippets together. Now just looking forward to la playa y el sol…

Friday, 18 September 2015

লইট্যা মাছের ঝাল চচ্চড়ি

যতদিন থেকে ব্লগ লেখা শুরু করেছি তাতে সাধারণত বিভিন্ন তত্ত্বের কচকচি আর গুরুগম্ভীর আঁতলামোই বেশি। আজ বরং অন্য স্বাদের কিছু লিখলাম। ২০১০ সালে যখন শেষ বারের জন্য কলকাতা গেছিলাম বাবাকে বলে রেখেছিলাম যে মাংস রোজ রোজ খাওয়াতে হবেনা, তবে মাছ যদি রোজ পাওয়া যায় তাহলে বেশ হয়।  এখানে ফেরার পর থেকে মাছ রান্না করেছি কয়েকবার তা সে Seabass কে গুরজালির মত করে রান্নাই হোক বা তেলাপিয়ার তেল ঝাল, রান্না ঠিকঠাক জমেনি আর মাছও যা পেয়েছি তা ঠিক আমাদের বাংলার মাছের মত নয়। একদিন পমফ্রেট খেয়েছিলাম বটে, আর ভারতীয় (আদতে বাংলাদেশী) রেস্তোঁরায় পাঙ্গাশ মাছ দেয় কম পয়সায় সারার জন্যে, কিন্তু সে রান্না ঠিক বাড়ির রান্নার মত নয়।  তাই মাছ না খেতে পাবার ফ্রাস্ট্রু ছিল বেশ কিছুদিন। সেদিন হঠাৎ ঠিক করলাম বাড়ির থেকে বেশ দুরে এক চিনে দোকানে যাবার। একে রবিবার, মেয়ে ঘ্যানঘ্যান করছে সারা সকাল, জেনিফার বলল চিনে দোকানে যাওয়া যাক অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম যাব যাব। গিয়ে দেখে এলাহী কান্ড, যেমন তেমন দোকান নয়, এখানে যাকে বলে superstore বাঁদিকে হোলসেলার ডানদিকে খুচরো জিনিসপত্র। চিনে খাবারের সাথে Chilli Oil আমার খুব প্রিয় সেই খুঁজতে খুঁজতে হাজির হলাম মাছের এলাকায়। একজোড়া পমফ্রেট কিনব কিনব ভাবছি, হঠাৎ দেখলাম ইংরেজিতে লেখা Loittya. ভাবলাম ব্যাপারখানা কী, এরকম নামের মিল তো পাওয়া সম্ভব নয় এ মাছ নির্ঘাত লইট্যাই হবে। ব্যাস ঠিক হয়ে গেল লইট্যা খাব, কিনে ফেললাম এক কিলোর বরফে জমানো লইট্যা। সাথে কিনলাম একগাদা মুলো আর বেগুন। বাড়ি এসে খেয়াল হলো আরে মুলো বেগুন তো লাগে লইট্যা শুঁটকিতে তাজা মাছে নয়। যাই হোক লইট্যা তো পাওয়া গেছে সেই আনন্দেই বাড়ি ফিরলাম।


আর বাকি বাঙাল বাড়ির মত আমাদের বাড়িতেও কিছু ফেলা হতনা খাবার আর লইট্যার স্বাদ তো দারুন। তেমন দেখিনি ঘটি বাড়িতে লইট্যা রান্না হতে, তবে ঘটি বাঙালের বিবাদ এখন পুরনো ব্যাপার, সেই দিকে নজর না দিলেও চলে। কিন্তু বাজারে ছোটবেলায় দেখতাম দোকানদারেরা বলত লটে মাছ যেটা শুনতে অনেকটা এপার বাংলার মত তাই মনে হয় চল যে একদম ছিলনা তা নয়। চাটগাঁর ভাষায় বলি লইট্যা বোধহয় সারা বাংলাদেশই সেই নামে জানে। এপার বাংলায় কিভাবে রান্না হয় জানা নেই তবে বাকি দু-দশটা বাঙাল বাড়ির মত আমাদের বাড়িতেও লইট্যা রান্না হত কষে ঝাল দিয়ে, সেই শুকনো শুকনো তরকারী গরম ভাত দিয়ে খাবার তুলনা হয়না। ছোটবংলায় লইট্যা পাওয়া যেত জলের দরে তেমন চাহিদা ছিলনা বলে। ওল কচু কচুর লতি এসবের মত লইট্যাও ধরা হত গরীব মানুষের খাবার নাকউঁচু লোকদের নয়। এখন দিনকাল পাল্টানোর সাথেসাথে লইট্যার জায়গা চড়া দাম হাঁকা ও ক্যালকাটা ভজহরি মান্না তেরো পার্বন ইত্যাদি ঘরোয়া বাঙালি রেঁস্তোরায় না হলেও বাজারে বাকী মাছের মত লইট্যাও আকাশছোঁয়া। লইট্যা নিয়ে একটা ছোট ঘটনা মনে পড়ল।  এ মাছের ইংরাজি নাম Bombay Duck. বহু ভাবনাচিন্তার পর আসল কারণ জানা গেল।  লইট্যার প্রথম চল ভারতের পশ্চিম দিকে। এই মাছের নাম ছড়িয়ে পরার সাথে সাথে বাংলায় ও তার চাহিদা এমন বাড়ল যে পশ্চিম থেকে লইট্যা আসত কলকাতায় বম্বে মেলে। লইট্যার চড়া গন্ধের জন্যে Bombay Mail (ডাক) এর নাম গিয়ে দাঁড়ালো চড়া গন্ধওলা যে কোনো কিছু। তাই লোকে ঠাট্টা করত যে গন্ধটা Bombay ডাকের (Mail) মত, কিন্তু সাহেবরা দুই দুই পাঁচ করে তার মানে ধরল লইট্যার নাম Bombay Duck. নামে আর কি আসে যায়, জিভে জল আসে সেটাই আসল।  কিছু কিছু রান্না আছে যা কোনো একটা এলাকার সাথে আগাপাশতলা জড়িয়ে।  লইট্যা মাছ তেমনি আমার কাছে বাঙাল পরিচয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে। বাকি  বাংলাদেশের প্রায় সব মাছই এখন কলকাতায় পাওয়া যায় তবে লইট্যা মাছ অনেকটা শুঁটকি মাছের মতই পুরোপুরি বাঙাল। চোখ বন্ধ করে বলতে পারি দুই বাংলার বাইরে লইট্যা খেতে পাওয়া প্রায় দুষ্কর যদিও পশ্চিম কূলে আর সাউথ চায়না সিতে পাওয়া যায় লইট্যা।  আর বেশি জ্ঞান না দিয়ে শেয়ার করলাম এই রান্নাটা।  আমার রেসিপিতে পরিমান সময় এসব আর ঘটা করে তেমন লিখলাম না, সেটা যে রান্না করবে তার ওপরেই ছাড় দেয়া রইল। 

লইট্যা মাছ টুকরো টুকরো করে কেটে নুন হলুদ মাখিয়ে রেখে দিতে হবে। ১ ইঞ্চি সাইজের পিস করলেই হবে।  মাথা লেজ বাদ দিয়ে রান্না করলেই ভালো, তাহলে শক্ত কাঁটা থাকবেনা। পেঁয়াজ কুচো করে কাটতে হবে।  কতখানি লাগবে সেটা কতটা কাই দরকার তার ওপর।  আমি ১ কিলো মাছে ৫০০ পেঁয়াজ দিয়েছিলাম, তবে আর একটু বেশি দিলে ভালো হত।  রসুন লাগবে অনেকটা।  আমি দেড়খানা বড় রসুন দিয়েছিলাম স্বাদ একদম ঠিকঠাক হয়েছে। বেশি দিলে হয়ত মাছের চেয়ে রসুনের গন্ধ বেশি পাওয়া যাবে। টমেটো বড় বড় পিস করে কেটে রেখে দিতে হবে। বড় কড়ায় বেশ খানিকটা সর্ষের তেল দিয়ে সেটা গরম হলে পেঁয়াজ ছেড়ে দিতে হবে।  খানিকটা ভাজা ভাজা হয়ে এলে যখন বাদামী রং ধরবে তখন রসুনবাটা আর গোটাকয় কাঁচা লঙ্কা দিয়ে আরো কিছুক্ষণ ভেজে তারপর টমেটো শুকনো লঙ্কা নুন হলুদ দিকে অনেকক্ষণ কষাতে হবে। শুকনো লঙ্কা গুঁড়ো বা বাটা যাই হোক না কেন অনেকটা দিতে হবে লালচে রং আর ঝালের জন্য।  কড়ায় পেঁয়াজ রসুন টমেটো সব যখন মিশে যাবে আর তেল ওপরে ভেসে উঠবে, তখন মাছগুলো কড়ায় দিয়ে দিতে হবে।  লইট্যা মাছ এমনিতে খুব নরম তাই সাবধানে মাছের টুকরোগুলোকে মসলায় মাখিয়ে করা ঢাকা দিয়ে দিতে হবে। এই মাছে প্রচুর জল তাই আলাদা করে জল দেয়ার দরকার নেই মাছ থেকে বেরোনো জলেই রান্না হবে।  আঁচ একটু পর ঢিমে করে দিয়ে খানিকক্ষণ ফোটাতে হবে। মাঝে মাঝে ঢাকা নামিয়ে দেখে নেয়া দরকার কড়ার তলা ধরে না যায় যাতে।  এমনিতে জল যতক্ষণে মরে যাবে কড়ায় ততক্ষণে মাছ রান্না হয়ে গেছে।  অল্প কাঁচা সর্ষের তেল আর কুচোনো ধনেপাতা ওপরে ছড়িয়ে দিলেই তৈরী লইট্যা মাছের শুকনো তরকারী। এখানে বলা নিস্প্রয়োজন যে ভাত ছাড়া এ রান্না খেলে তেমন আনন্দ পাওয়া যাবেনা। গরম ভাতে শুধু শুধু তরকারী বা পাতলা মুসুর ডালের সাথেই সাধারণত লইট্যা মাছ জমে দারুন। বলে রাখা ভালো যে কখনো আগে লইট্যা খায়নি যে এতে বড় শিরদাঁড়ার কাঁটাটা খাবার সময় ছাড়িয়ে নিলে খালি সুতোর মতো কিছু কাঁটা আছে যেগুলো মুখে আটকায়না।  শিরদাঁড়া তেমন দরকার হলে গোটা মাছ হালকা সেদ্ধ করে ছাড়িয়ে নেয়া যায় তবে অত ঝক্কি করার তেমন দরকার নেই।  


পরের বার ইচ্ছে আছে মাছের বড়া বানানোর, তবে তার রেসিপি লেখার মত কিছু নয়। যদি শুঁটকি মাছ রান্না করি তখন আবার লিখবখন।

Friday, 11 September 2015

কলকাতার একাল সেকাল — অন্তিম পর্ব ১৯০০-১৯৮০

লেখাটা শুরু করেছিলাম কলকাতা নিয়ে আমার যা যা স্মৃতি আছে সেগুলো বয়ান করার জন্য। দেখতে দেখতে সেই লেখা হয়ে দাঁড়ালো কলকাতার তিনশ বছরের ইতিহাসে। ইতিহাসে কোনো আগ্রহ স্কুলে থাকার সময় একদম ছিলনা, পরে ইতিহাস জানার ইচ্ছে হলেও দেখলাম ইতিহাস আসলে হলো যে যেরকম করে বলতে চায় তার বলা গল্প। আগের দুটো পরিচ্ছদে কলকাতা নিয়ে যা লিখলাম সেটা আমার ভার্সন বলা যেতেই পারে, বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনা আর তথ্যের সঙ্কলন। যা শুরু করেছি তা শেষ অবধি চালিয়ে যাব বলেই মনস্থির করলাম, তাই এই লেখাটা কলকাতার আধুনিক যুগ নিয়ে, তবে রেঞ্জটা ১৯৮০ তেই শেষ করব।  বাকি অংশটা অন্য আরেক লেখায় লিখব, আমার নিজের স্মৃতি থেকে, বেদের মত চর্বিতচর্বন করে নয়।  

Courtesy: Tumblr@greenjaydeep
বিংশ শতকের গোড়ার কলকাতা বলতে গেলে অতীতের কঙ্কাল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতাকে ঘিরে গড়ে তোলা সাম্রাজ্য তখন শেষের দিকে। আঠার শতকের সেই লন্ডনকে টেক্কা দেয়া বিত্ত বৈভব তখন প্রায় লুপ্ত, উত্তর কলকাতার বাবুসমাজও তখন অবক্ষয়ের পথে।  কোম্পানিকে ভর করে সঞ্চিত সম্পদ অপব্যয় করে তাদের অবস্থা পড়তির দিকে। বরং সমাজে চালকের জায়গা করে নিয়েছে উচ্চবংশের উচ্চশিক্ষিত মানুষজন, তবে আগের দুই শতকে যা খুব কম দেখা গেছে সেই সাধারণ ঘরের অতি মেধাবী মানুষেরাও তখন একাসনে অবস্থান করে নিয়েছে। ১৮৮৫ সালে গড়ে ওঠা কংগ্রেসের হাত ধরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও শুরু হয় উনিশ শতকের শেষের দিকে। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন ঠিক করলেন বাংলার এই জাতীয়তাবাদী চিন্তার উত্থান বন্ধ করার জন্যে বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যা কে দুই ভাগে ভাগ করা হবে।  সারা ভারত তার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠল, যার প্রধান বিরোধিতা হলো কলকাতাকে কেন্দ্র করেই। বহু প্রতিবাদ বিরোধ জনআন্দোলনের পর ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করে।  কিন্তু সেই Divide  and Rule এর যে বিষ ছড়িয়ে দিয়ে গেল ব্রিটিশ সরকার সেই ছ বছরে, তার জের এখনো হাজার হাজার হিন্দু মুসলমান পরিবার ভোগ করে চলেছে। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করার সাথে সাথে ব্রিটিশরা তাদের রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গেল দিল্লিতে, স্বাধীনতা সংগ্রামের আঁচ যাতে সরকারের গায়ে না লাগে।  দুশ বছরেরও বেশিকাল ধরে যে কলকাতাকে ব্রিটিশরা গড়ে তুলেছিল বানিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধির জন্যে, বাংলা বিহার উড়িষ্যা অসমের কাঁচামাল হরণের পর তার প্রয়োজন তখন ফুরিয়েছে, আর কলকাতার সেই তিলোত্তমা রূপও তখন আর নেই - কলকাতা মানে তখন এক পূতিগন্ধময় অস্বাস্থ্যকর Black Hole ।  

কলকাতার গল্প তো এখানেই শেষ হতে পারত, অতীতের সেই সোনার দিনগুলো পেরিয়ে সে তখন কাতারে কাতারে মানুষের ভারে ন্যুব্জ এক শহর, যার তুলনা হতে পারতো মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলন বা উর। না, কলকাতা সেখানে থেমে যায়নি, বরং রাজধানী খেতাব থেকে মুক্তি পেয়ে বোধহয় আপন খেয়ালে নিজের গতিতে এগিয়ে চলেছে।  তার প্রধান কারণ অবশ্যই যে ব্রিটিশ রাজধানী হবার সূত্রে যে পরিকাঠামো গত দুই শতকে তৈরী হয়ে ছিল, তার প্রভাব বিন্দুমাত্রও ক্ষুণ্ণ হয়নি, অন্তত রাজধানী বদলের সাথে সাথে তো নয়ই।  কলকাতা তখন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির রাজধানী, তাই তার রাজনৈতিক প্রভাব বা তাৎপর্য ব্রিটিশদের কাছে তখনও অশেষ। তার সাথে যোগ হবে কলকাতার রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বিজ্ঞান ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাফল্যের তুঙ্গে উত্তরণ। রবীন্দ্রনাথ আশুতোষ জগদীশচন্দ্র প্রফুল্লচন্দ্র সি ভি রমন বিবেকানন্দ প্রমুখ মানুষের  অবদানের পথ ধরে কলকাতার উনিশ শতক থেকে কুড়ির শতকে পা রাখা। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ারে প্রফুল্লচন্দ্র গড়লেন বেঙ্গল কেমিকেল যা এখনো বাঙালির ঘরে ঘরে।  ১৯০৮ অলিম্পিক এ শোভাবাজার এর নর্মান প্রিচার্ড  সোনা পেলেন, ১৯১৩য় রবীন্দ্রনাথ পেলেন প্রথম এশীয় নোবেল। ১৯১১ সালে মোহনবাগান ইতিহাস সৃষ্টি করলো প্রথম ভারতীয় ফুটবল দল যারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে।  এসব তথ্য এখন হয়ত কেবলই পরিসংখ্যান অথবা কুইজের প্রশ্ন কিন্তু সেই সময়ে ফিরে গেলে কলকাতার যে আমূল পরিবর্তন ঘটছিল দুশ বছর পুরনো এক ঔপনিবেশিক সত্ত্বার প্রভাব কাটিয়ে দেশীয় স্বাধীন চিন্তা এবং মেধার উন্মেষে তা এককথায় অভূতপূর্ব আর বিস্ময়কর। 

 প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ভারত স্বাধীন হওয়া অবধি কলকাতার ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ মূলত স্বাধীনতা আন্দোলনকে ভিত্তি করে।  ক্ষুদিরাম প্রাফুল্ল চাকি থেকে শুরু করে সেই বিপ্লবী প্রতিবাদ জারি রয়ে গেল বারীন ঘোষ, চিত্তরঞ্জন, অরবিন্দ, নেতাজি সুভাষ যতীন দাস বিনয় বাদল দীনেশ এঁদের মধ্যে। গোটা ভারতের মত কলকাতাও সেই জ্বালাময়ী সময়ের সাক্ষী বিশেষ করে স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে চিহ্ণিত হয়ে থাকবে সারা বাংলা। এই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সবার দান অশেষ আর প্রত্যেকের অবদান নিয়েই এক একটা গোটা অধ্যায় লিখে ফেলা যায় কাজেই স্বাধীনতা আন্দোলনের ভূমিকা কলকাতার পরবর্তীকালের ইতিহাসের পক্ষে অপরিসীম হলেও সে বিষয়ে আর গভীর আলোচনায় জড়ালাম না।

এরই মাঝে মাঝে কিছু বিক্ষিপ্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যা আজকের কলকাতার উত্থানের সাথে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে সেগুলো তুলে ধরলাম। ১৯২৪ সালে কলকাতা অবশেষে পেল সেই অপূর্ব মর্মর সৌধ যার ভিত্তিপ্রস্তর ইংলন্ডের রাজা ষষ্ঠ জর্জ করে গিয়েছিলেন ১৯০৬ সালে - ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। কলকাতায় এখনো কেউ আসলে যদি জিগ্গেস করে কি কি দ্রষ্টব্য ছাড়া চলবেনা, ভিক্টোরিয়া সেই তালিকায় একদম প্রথমে থাকবে। প্রায় একশ বছর পেরিয়েও এই সৌন্দর্য আর লাবন্যে বিন্দুমাত্র ভাঁটা পড়েনি। এই ১৯২৪ সালেই কলকাতা কর্পোরেসানের প্রথম মেয়র হলেন চিত্তরঞ্জন দাশ।  এর কিছুদিন পরেই এসে উপস্থিত হলেন এক যুগোস্লাভিয় সেবিকা, যাঁর নাম এখন কলকাতার পরিচয়ের সাথে সমার্থক। সুদুর লাতিন আমেরিকার, দূর প্রাচ্যের ক্যাথোলিক দেশগুলিতেও কলকাতার নাম ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে এই মহিয়সী মহিলার আত্মদান অনস্বীকার্য —  মাদার টেরেসা। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে গঙ্গার দুকুল বাঁধা পড়ল কারিগরী বিদ্যার এক অসাধারণ উদাহরণে। হাওড়া ব্রিজ আজও মানুষের মনে বিস্ময় জাগায় কোন নাটবল্টু ছাড়া কেবলমাত্র রিভেট দিয়ে গড়া এই সেতু কেমন করে আজও এই বিপুল পরিমান যানবাহন বহন করে চলেছে। এই সময়ের কলকাতা যেমন দেখেছে প্রগতি আর সাফল্য তেমনই ক্ষণেক্ষণে ঢেকে গিয়েছে দুঃশঙ্কার মেঘে। বিদেশীদের divide and rule নীতির কবলে পরে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে বিভেদের বিষ ছড়িয়ে গেল, তার সাক্ষ্য বহন করবে একের পর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার বলি হলো সবচেয়ে বেশি মানুষ। কলকাতার পুরনো কিছু ছবিতে দেখেছি রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা লাশ হিংস্র ধর্মান্ধতার আর সাম্রাজ্যবাদের শিকার। বিশ্বযুদ্ধের সময় গোঁড়া সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের উপহার কলকাতার মন্বন্তর যেখানে লাখে লাখে মানুষ অনাহারে প্রাণ হারায় খাদ্যের যোগান থাকা সত্তেও। ১৯৪১ এ ২২শে শ্রাবণ চলে গেলেন কবিগুরু, কলকাতা তথা বাংলার সাহিত্য জগতে এক বিশাল শুন্যতার সৃষ্টি করে।  আর কিছু বছর পর, ১৯৪৫ য়ে জাপান যাবার পথে অন্তর্ধান হয়ে গেলেন ভারতীয় সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরোধা নেতাহী সুভাষ যাঁর অন্তর্ধান আজও এক রহস্য।  এই সব টানাপোড়েনের মাঝে ১৯৪৭ সালে এল সেই দিন, যার জন্যে সারা ভারতের মাতা কলকাতাও অপেক্ষা করে ছিল অনন্ত কাল, নতুন ভারতের পটভূমিতে সূচনা হল কলকাতার নতুন রূপান্তরের।  ঔপনিবেশিক অতীতকে ভিত্তি করে, এক স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের উদ্দেশ্যে সেই রূপান্তর।

স্বাধীনতা পরবর্তী কলকাতা যে রাতারাতি এক সম্পূর্ণ পরিবর্তীত মহানগরে পরিনত  হবে সেই আশা কেউই করেনি। তখনকার কলকাতা প্রাণে ভারতীয় হলেও প্রাতিষ্ঠানিক সরকারি কার্যকলাপে তখনও বিদেশী, ব্রিটিশ শাসকরা চলে গেলেও অধিকাংশ শিল্প বানিজ্য প্রতিষ্ঠান তখনও চালাচ্ছে ব্রিটিশরা। এছাড়া স্বাধীনতার পরে দেশভাগের সাথে সাথে কাতারে কাতারে হিন্দু পরিবার পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে আসে পশ্চিমবঙ্গে, আর স্বভাবতই রোজগারের আশায় বেশির ভাগই হাজির হয় কলকাতায়। কলকাতার তখনকার নগর পরিকাঠামো এই জনসংখ্যা বিস্ফোরণের জন্যে বিন্দুমাত্রও প্রস্তুত ছিলনা, কিন্তু তখনকার কলকাতায় সম্প্রসারণের জায়গা ছিল প্রচুর। হাজার হাজার উদ্বাস্তু মানুষের ঠাঁই হলো কলকাতার দক্ষিনে যোধপুর যাদবপুর টালিগঞ্জ বেহালা বেলেঘাটা ইত্যাদি এলাকায়। এই বিপুল পরিমান মানুষের মাথা গোঁজার জায়গা করে দেয়ার জন্যে সরকার অনেক ফ্ল্যাট তৈরির কাজে হাত লাগলেও, বেশির ভাগই তৈরী করে নিল নিজেদের আশ্রয় জমি দখল করে বস্তি বানিয়ে। তুলনামূলক ভাবে অবস্থাপন্ন বাঙালরা গেল আর একটু উত্তরে, বালিগঞ্জ কালিঘাট ভবানীপুরের দিকে, প্রধানত এপার বাংলার মানুষদের এলাকার সীমানায়। পূর্বের বাঙাল আর পশ্চিমের ঘটি এই দুই বিপরীত সংস্কৃতির মানুষের এই প্রথম বিপুল হারে সংমিশ্রন। ভাষা আচার জীবনযাপনের যে চরম বৈষম্য ছিল প্রথমের দিকে, সেটা সম্পূর্ণ দূর হতে লেগেছে আরো কয়েক দশক, কিন্তু এই দুই সংস্কৃতির মিশ্রনে কলকাতার বাঙালি সমাজ এক নতুন এবং অনন্য মাত্রা পেল।  স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া এবং আরো বেশ কিছু বছর পর অবধি আরো প্রচুর মানুষ প্রানের ভয়ে বা জীবিকার সন্ধানে পূর্ব বাংলা থেকে বাসা গুটিয়ে এসে উপস্থিত হয়েছে কলকাতায়, আর এই শহর তাদের গ্রহণ করেছে সানন্দে। নিউ ইয়র্ককে লোকে বলে big apple কিন্তু কলকাতা যে পরিমান মানুষের খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের উপায় করে দিয়েছে সে হিসেব খুঁজে পাওয়া দুস্কর। তার পরিবর্তে এই শহর পেয়েছে তার অনন্য পরিচয়। এ শহর ঘটির নয়, বাঙালের নয়, দেশ স্বাধীনের পর রয়ে যাওয়া হাজার হাজার অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের নয়, চিনে দর্জি, ইহুদি পারসী আর্মেনীয় ব্যবসায়ীদের নয় নয় জীবিকার খোঁজে আশা বিহারী ঠেলাওয়ালা উড়ে ঠাকুর মারোয়ারী ব্যবসায়ীর — এ শহর এদের সবার সম্মেলনে গড়ে ওঠা এক অনবদ্য সৃষ্টি, যার ইতিহাস হাজার হাজার বছরের পুরনো নয় কিন্তু ভাষা ধর্ম জাতির বৈচিত্রে কলকাতার সমগোত্রের মহানগরী ভারতে কেন সারা পৃথিবীতে বিরল। 

এই বিপুল সংখ্যক জনগণ কলকাতায় আসার পরিপ্রেক্ষিতে আরো একটা ঘটনা ঘটছিল স্বাধীনতার আগে থেকেই কিন্তু ১৯৪৭ এর পরে তার হার অনেকগুণ বেড়ে গেল। ভারতবর্ষে কম্যুনিস্ট মার্ক্সবাদী দর্শন এবং রাজনীতির পথিকৃৎ বলতে গেলে মানবেন্দ্রনাথ রায়।  জমিদার সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার দাবি করার প্রস্তাব বিশেষ করে ভারতবর্ষের মত বৈষম্যমূলক দেশে সাধারণ মানুষের কাছে প্রবল সমর্থন পেতে লাগলো। বিশেষ করে দেশভাগের পর যখন ভারতে রাজনৈতিক দল বলতে কংগ্রেস ছাড়া আর কারো নাম করা যায়না আর কংগ্রেস তখন কুলীন জনগনের পার্টি আম জনতার নয়।  এই পটভূমিতে কলকাতায় বামপন্থী আন্দোলনের সূত্রপাত হয় স্বাধীনতার পর পরই যার চূড়ান্ত পরিনতি হলো বামপন্থী দলের ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসীন হওয়া। ষাটের দশকে গোটা বিশ্বের বামপন্থী আন্দোলনের হাওয়া কলকাতাতেও চরম ভাবে প্রতিফলিত হয় যার হাত ধরে এলো কলকাতার দ্বিতীয় সাংস্কৃতিক রেনেসাঁস ও উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ। সাহিত্যে সুনীল সমরেশ শীর্ষেন্দু শক্তি চলচ্চিত্রে সত্যজিত ঋত্ত্বিক মৃনাল সেন অভিনয়ে উত্তম সুচিত্রা সৌমিত্র উৎপল দত্ত সঙ্গীতে মান্না দে সলিল চৌধুরী এঁদের হাত ধরে বাঙালির যে চরম বুদ্ধিগত উত্তরণ ঘটে এই সময় তার মূলে ছিল বামপন্থী আন্দোলন এবং উদারিকরনের আহ্বান। সেই আন্দোলনের সাংস্কৃতিক বিস্তারে কলকাতার অবদান অনস্বীকার্য। ধর্মতলা কলেজ স্ট্রীট পার্ক স্ট্রীট এককথায় সমগ্র মধ্য এবং দক্ষিন কলকাতা এই নতুন সীমানাহীন জীবনের হাতছানিকে বাস্তবে রুপান্তরের অভিযানের কেন্দ্রে।

বামপন্থী আন্দোলনের তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনে কলকাতার তরুণ প্রতিভারা নেতৃত্বে থাকলেও আসল লড়াইটা চলছিল সমস্ত বাংলায়, কৃষক শ্রমিক মজুরদের হাত ধরে।  একই ভাবে কলকাতার শহরতলীতেও সেই প্রতিবাদী বামপন্থী আন্দোলনের কৃতিত্ত্ব লেখক শিল্পীদের সাথে সাথে সেই অগুন্তি অদৃশ্য মানুষদের যাদের এতদিন কোনো ভাষা ছিলনা।  মিছিল ধর্মঘট অবস্থান ঘেরাও সব বিভাগে কম্যুনিস্ট আন্দোলনের যে জোয়ার কলকাতাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ষাটের দশকে সেখানে বড় ভূমিকা ছিল কলকাতার সেই উদ্বাস্তু পূর্ববঙ্গীয় সম্প্রদায়ের।  যাদবপুর বিজয়্গড় লেক গার্ডেন্স টালিগঞ্জ বালিগঞ্জ ইত্যাদি এলাকায় উদ্বাস্তু মানুষদের কলোনিগুলো হয়ে উঠলো সেই প্রতিবাদ আন্দোলনের মূল কেন্দ্র। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা এই মানুষরা ভারতে এসেছিল সবকিছু খুইয়ে, কলকাতায় তাদের আশ্রয় বলতে অস্বাস্থ্যকর একচালা ঘর, জীবনধারনের জন্য প্রত্যেকদিন লড়াই।  এই অবস্থায় তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার সাম্যবাদ এই মানুষদের আবার স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল বৈষম্যমুক্ত এক সমাজের। 

এই ছবিটা আমূল পাল্টে গেল সত্তরের দশকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বাধ্য করলো লাখে লাখে হিন্দু পরিবারকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে আসতে। সবাই যে আসতে পেরেছিল তা নয়, তবু কলকাতার জনসংখ্যা এই সময় যেমন হঠাত এক লাফে অনেকগুণ বেড়ে গেল, তেমনি বিশ্বজুড়ে বামপন্থী আন্দোলনের নুতন ভাঙাগড়ার প্রভাব এসে পৌছালো কলকাতার অলিগলিতেও। এক শ্রেণী চাইছিল সশস্ত্র সংগ্রাম বলশেভিক বিপ্লবের মত বা মাওয়ের পথ অনুসরণ করে।  অন্য দল ছিল তখনও রাশিয়াবাদী, তাত্ত্বিক বামপন্থাকে প্রশ্ন করা মানেই প্রতিক্রিয়াশীল ছাপ পড়ে যাওয়া। এই টানাপোড়েনের মাঝে শুরু হলো নকশালবাড়ি আন্দোলন, যার আঁচ কলকাতাকেও গ্রাস করে নিল সাথে সাথে। শুরু হয়ে গেল প্রবল গোষ্ঠীদ্বন্ধ, ছেচল্লিশয়ের দাঙ্গার পর আবার এক রক্তাক্ত অধ্যায়। ১৯৭২ সালে মুখ্যমন্ত্রী হলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়।  নকশাল বিপ্লব দমন করতে তিনি তাদের চেয়েও ক্রুর ভূমিকা নিলেন যেটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল কিনা জানা নেই। শুরু হয়ে গেল পুলিশের তত্ত্বাবধানে রাজনৈতিক হত্যা, গুপ্ত হত্যা, নকশালদের হাতে পুলিশ আর সিপিএম খুন, সিপিএমের হাতে নকশাল খুন, কংগ্রেস আর পুলিশের হাতে নকশাল আর সিপিএম খুন। অবশেষে এসবের অবসান ঘটিয়ে ১৯৭৭ সালে সেই প্রায় কুড়ি বছরের আন্দোলনের ফল হিসেবে সিপিএম এলো ক্ষমতায় — তবে নকশাল পিরিয়ড চলেছিল আরও অনেক বছর ধরে, সিপিএম ক্ষমতায় আসার পরেও।

কলকাতার স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাস লিখতে গিয়ে সেটা দাঁড়াল রাজনৈতিক ইতিহাসে কিন্তু কলকাতার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে জড়িয়ে আছে রাজনীতি তাই এর চেয়ে সহজভাবে এই তিরিশ বছরের  ঘটনাবলী লেখা যেতনা। রাজনীতি ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে কলকাতার গতিবিধি নজর করে নেয়া যাক এক ঝলকে। স্বাধীনতার পর থেকে বিপুল পরিমান মানুষের সমাগম কলকাতার নগর পরিকাঠামোর উপর অসীম চাপ সৃষ্টি করে।  বিধান রায়ের স্বপ্নের প্রকল্প সল্টলেক এলাকায় নির্মান কাজ শুরু হয় ১৯৫৮ সালে। জলাজমি ভরিয়ে গড়ে ওঠা সেই উপনগরিতে তখন মানুষ যাবার কোন আগ্রহই দেখায়নি, তবু দুই দশক পরে যখন কলকাতার পথব্যবস্থা প্রায় অচল, প্রচুর পরিকল্পনা করে গড়ে তোলা এই উপনগরী তখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবু যারা সল্টলেকে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বেশির ভাগই প্রতিষ্ঠিত মানুষ জমি এবং বাড়ি তৈরির মূলধন তাদের তখন ছিল।  তবে সল্টলেকে সরকারি কিছু ফ্ল্যাটও তৈরী হয় সাধারন নিম্নবিত্ত মানুষদের জন্য। একইভাবে বলা যেতে পারে দক্ষিণ কলকাতার বিস্তৃতি। বালিগঞ্জ ছাড়িয়ে গোলপার্ক ঢাকুরিয়া যাদবপুর সেই সময়ে প্রচুর সম্প্রসারিত হয়, বিশেষ করে রিফিউজি মানুষদের সংস্থানের জন্য। একের পর এক গড়ে ওঠে সরকারি চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি ন্যুনতম ভাড়ায়। আরেক দিকে কলকাতা বেড়ে উঠছিল দক্ষিন পশ্চিমে বেহালায় যা স্বাধীনতার আগে ছিল মূলত জলাঞ্জলি আর শিল্পাঞ্চল। কলকাতার পরিবহন পরিষেবা গড়ে ওঠে ষাটের দশকের গোড়ায় মূলত সরকারি CSTC বাস দিয়ে, তার পর একে একে যুক্ত হয় প্রাইভেট বাস মিনিবাস ইত্যাদি। ১৯৭১ সালে তৈরী হয় মেট্রো রেলের মাস্টার প্ল্যান যার পরিনতি ১৯৮৪ সালে ভারতবর্ষের প্রথম ভূতল পরিবহম ব্যবস্থা যা আজও কলকাতার গর্ব। ষাটের দশকে গড়ে ওঠে রবীন্দ্র সদন।  জীবনযাত্রার দিক দিয়ে দেখতে গেলে কলকাতা তখন শিক্ষা সংস্কৃতি পান্ডিত্যে ভারত সেরা যার নমুনা চলচ্চিত্রে সংগীতে লেখায় শিল্পে অগুন্তি।  মানুষ বামপন্থী আন্দোলনের আবেগে অনুপ্রানিত হয়ে প্রতিবাদী চিন্তাধারার প্রতিভূ যেখানে expressionয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই কলকাতায় তখন পাড়ায় পাড়ায় গান নাচ আবৃত্তি আঁকা ইত্যাদির ছড়াছড়ি। সেখানে খেলার স্থান তবে শুন্য। কলকাতার তিন প্রধান ছাড়াও প্রথম ডিভিসন ফুটবল লিগের দলগুলো অসাধারণ ফর্মে থাকলেও, কলকাতা থেকে খুব কম ফুটবলারই উঠে এসেছে সেই সময়। তবু তখনো ভারতে ফুটবল মানেই কলকাতা। 

আশির দিকে কলকাতায় এলেন ফরাসী লেখক দমিনিক লাপিয়ের। শহর তাঁর মন জয় করে নিল, কলকাতাকে তিনি বললেন City of Joy. এ শহরে দারিদ্র্য প্রবল, পরিকাঠামো অচল তবু মানুষের মুখে হাসি আছে, আছে জীবনকে উপভোগ করার আত্মবিশ্বাস। একাধারে কলকাতা যেখানে যাত্রা শুরু করেছিল কুড়ির শতকের গোড়ায়, সেই একই প্রগতি বজায় থেকেছিল আশির দশকের গোড়া অবধি। আশির পরের কলকাতায় প্রগতি থেমে যায়নি বরং বেড়েছে, শুধু পরবর্তী সময়কালের লেখাটা নিজের স্মৃতির ওপর ভরসা করে লিখব বলেই আশিতে এই লেখা থামানোর পরিকল্পনা। কলকাতা এই সময় অবধিও ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী। প্রায় তিনশ বছরের ইতিহাসে কলকাতার যে হার না মেনে নেয়ার ক্ষমতা দেখা গেছে, সেখান থেকেই বলা যেতে পারে যে কলকাতা এখনো মৃতনগরী নয়, কলকাতা আছে কলকাতাতেই। আমার শহর আমার গর্ব আমার City of Joy.


Courtesy: Steve McCurry
Calcutta, the Living City: The past
Calcutta, the Living City: The present and future