Showing posts with label philosophy. Show all posts
Showing posts with label philosophy. Show all posts

Saturday, 22 August 2015

Legacy of Tagore in present world: a savant or an idol

A poignant article on tagore's relevance to the contemporary world...what is his relevance in our lives now? Have we adopted his ideas of a free society or his image on the pantheon of Bengali vainglorious psyche?

"Where the mind is without fear and the head is held high
Where knowledge is free
Where the world has not been broken up into fragments
By narrow domestic walls" 

Have we freed our mind and thoughts yet?

Finally, who do the world look up to now as the messiah for free thinking transgressing the limits of time and geographic boundaries? Why does the world lack inspirational thinkers? In Science and Technology, barriers are broken every day that pushes the limit of what humans can do; why isn't there similar advances in social spheres?

Tagore knew that his Western image was not his real self.

Sunday, 26 April 2015

বাঙালী জীবনে ধর্ম ও আধ্যাত্মচেতনা

এবার মনে হয় লেখা শুরু করার আগে একটা disclaimer দিয়ে রাখা প্রয়োজন। আমার কৈশোর, ছাত্র আর কর্মজীবনে অনেক লোকের সাথেই পরিচিতি হয়েছে কিন্তু সংখ্যাটা তেমন বিশাল নয় যা থেকে পশ্চিমবঙ্গবাসী বাঙালী জাতির ওপর সামগ্রিক উপসংহার করা যেতে পারে। আমার লেখাগুলোকে তাই বাস্তবের চেয়ে বেশী কাল্পনিক, নিদেনপক্ষে সীমিত কলকাতাভিত্তিক বাস্তব অভিজ্ঞতার দূরদর্শন (extrapolation) বললে যথার্থ হবে। কারও যদি তাই কোন অসঙ্গতি ধরা পড়ে সেটা সম্পূর্ণ সীমিত অভিজ্ঞতার কারনে, সত্যিকে অতিরঞ্জিত করার কোন উদ্দেশ্য আমার নেই। 

মূল প্রসঙ্গে আসি। আধ্যাত্মিকতার ধারনাটা খুবই গভীর সাধারন মানুষের সেই অতলে তলিয়ে ভাবনাচিন্তা করার না আছে সময় না আছে সেই নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি।  আধ্যাত্মিকতার মুল ধারনা কোথাও পড়েছিলাম আত্মানং বিদ্ধি যার মানে খুব সম্ভব নিজেকে জানা। সে বিদ্ধি আমার নাম কি, বাবার নাম কি বা বাড়ি কোথায় জাতীয় বিদ্ধি নয়, বরং মনের গভীরে ডুব দিয়ে নিজের জীবনের উদ্দেশ্য, এই বিশাল মহাবিশ্বে নিজের অস্তিত্বের উপলব্ধি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার প্রয়াস। প্রশ্নের উত্তর যে পাওয়া যাবে একদিন তা নিশ্চিত নয়, বরং যত গভীরে যাওয়া যাবে ধোঁয়াশা ততই বাড়বে, যত না নিজেকে জানা যাবে তার চেয়ে বেশী বোঝা যাবে কতটা জানা নেই বা জানতে বাকী আছে। অনেকটা আইনস্টাইনের (নাকী অ্যারিস্টোটল?) জ্ঞানের সমুদ্রতীরে নুড়ি কুড়নোর গল্পের মত। যত বেশী নুড়ি জমা হবে কত মনে হবে জ্ঞানের সমুদ্রের পরিধি ঠিক বঙ্গোপসাগরের মত নয় সেটা বাড়তে বাড়তে প্রশান্ত মহাসাগরে দাঁড়িয়েছে, ফলে আরো অনেক নুড়ি কুড়তে হবে সমুদ্রে ঝাঁপ মারার আগে। এরূপ জটিল তত্ত্ব ভাবার বিলাসিতা খেটে খাওয়া সাধারন মানুষের কাছে আকাশকুসুম কল্পনা। আধ্যাত্মিকতা তাই তার ভূমা থেকে ছোট হতে হতে পৌত্তলিকতা আর আচারবিচারে এসে ঠেকেছে। আর এই সঙ্কীর্ণতা থেকেই আধ্যাত্মিকতা এখন ধর্মের সমার্থক, আধ্যাত্মিক হতে গেলে ধার্মিক হতেই হবে, কিন্তু উল্টোটা তেমন খাটেনা, বেশীরভাগ ধার্মিকই গড্ডালিকাপ্রবাহে গা ভাসায়, তারা বিন্দুমাত্রও আধ্যাত্মিক নয়।  ঠিক যে কারনে নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি অতি অপরিহার্য আধ্যাত্মিক হবার জন্য। 

ছোটবেলার একটা ঘটনা খুব মনে আছে যদিও বয়স তখন ছিল পাঁচের কাছাকাছি। বাড়িওয়ালি দিদার মেয়ের বন্ধু হ্যাংচুপিসির কাছে মুখচোখ পাকিয়ে বলছি কৃষ্ণনগরে কালীবাড়ির পাশে সিঙ্গারা ভাজে ছোট ছোট, টাকায় আটটা, বললে দশটাও দেয়। তারা তো শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ছিল কেমন গাল ফুলিয়ে বড়দের মত কথা বলছি বলে, কিন্তু ভেবে দেখলে এভাবেই ছোট বয়স থেকে ধর্মচেতনা আসে বিভিন্ন প্রতীকের মাধ্যমে যার সাথে আধ্যাত্মিকতার তেমন যোগাযোগ নেই। তাই সেই বয়স থেকে শুরু করে নাস্তিক হবার সিদ্ধান্ত অবধি আমার কাছে খাবার আর ধর্মের এক গভীর যোগ ছিল, সে কালিঘাটের প্যাঁড়া আর ঢাকাই পরোটাই হোক বা পাড়ায় শনিপুজোর পর তামিল ধোসাওয়ালার তাওয়ায় ঠংঠং খুন্তি বাজানোই হোক। সেভাবেই ধর্মীয় আচারের সাথে জড়িয়ে রাখা হয়েছে গুরুগম্ভীর সংস্কৃত মন্ত্র যাতে মানে কী বুঝলাম না বুঝলাম এসে যায় না, তবে শুনতে বেশ ঘ্যামা লাগে। বিভিন্ন ধর্মীয় আচারে তা সে পুজো পৈতে শ্রাদ্ধ যাই হোক না কেন, পুরোহিত যখন মন্ত্র আওড়াতে বলে মনে হয় অনেকটা ক্রেডিট কার্ডের Terms & conditions পড়ার মত, বুঝলাম কিনা জানিনা তবে পাতার নিচে সইটা করতেই হবে। 

আমরা বাঙালীরা চিরকালই হুজুগে। তা না হলে আমাদের সেরা উৎসব দুর্গাপুজা হয়? দুর্গাপুজা দেখতে গেলে প্রায় শুরু থেকেই একটা বানিজ্যিক ব্যাপার, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের বৃটিশদের অনুগ্রহ লাভের মাধ্যম বই অন্য কিছু নয়। তার পর উনিশ শতকে সেটা দাঁড়ায় তাঁবেদার জমিদারদের পয়সা ওড়ানোর আর সেই সাথে বৃটিশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন, এককথায় একটা marketing campaign. তাই আজ যখন পুজা সমিতি গুলো কোটি টাকার বাজেট করে পুজা করে ভিড় টানার জন্য, তখন "দিনকাল উচ্ছন্নে গেছে, এখন সব টাকার খেলা, বাড়ির পুজোগুলো কী ভাল ছিল" জাতীয় নস্টালজিক ভাবনাগুলো যে আসলে একটা মিথ্যের ওপর ভিত্তি করে তা বলাই বাহুল্য। 

আর এক উদাহরণ হল সন্তোষীমা, যিনি আদপে কোন বৈদিক দেবীই নন তবে কাতারে কাতারে মহিলারা যে সন্তোষীমার পুজা শুরু করলেন সেটাও দেখতে গেলে কোন  খাঁটি ব্যবসায়ীর কল্পনাপ্রসূত আর পুরোহিতরাও টাকাকড়ি কামানোর উদ্দেশ্যে সেই হিড়িকে তাল মেলাল। অনেকটা অটোতে বাড়তি যাত্রী তোলার মত বিভিন্ন মন্দিরে সন্তোষীমার জায়গা তৈরী হয়ে গেল আনাচে কানাচে। অর্থনীতির চাহিদা আর যোগানের যে সমীকরণ বাঙলায় ধর্মেরও সেই হাল, মতলববাজ পুরোহিত আর মন্দির কমিটিগুলো তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর পসরা সাজিয়ে বসে আছে, আর অন্যদিকে হুজুগে পাবলিকও সেই হুল্লোড়ে গা ভাসিয়ে তাদের খেটে রোজগার করা টাকা পয়সা জলাঞ্জলি দিচ্ছে। তাই যখন দেখি কোন মাথামোটা কালিঘাটের কালীর জন্য সোনার জিভ গড়িয়ে দেবার ঘোষনা করছে, মনে হয় ফিরে আসুক নক্সালরা, লুঠে নিক এইসব বকধামর্িকদের সম্পদ আর বিলিয়ে দিক প্রান্তিক অভুক্ত মানুষদের কাছে। 

এর সাথে যোগ হবে রাজনৈতিক পাড়ার লিডারদের মাস্তানি যার নিদর্শন হল শিব আর শনিমন্দিরের বাড়াবাড়ি। আজকাল বিজেপির কল্যানে অনেকে ঘ্যানঘ্যান করে যে মোড়ে মোড়ে মসজিদ বানানো হচ্ছে তাদের এই শিব আর শনিপুজোর ঘটা নিয়ে কেমন প্রতিবাদ নেই। কলকাতায় মনে হয় অন্ততপক্ষে যতগুলো বাসস্টপ আছে ততগুলোই শিব আর শনিমন্দির রয়েছে, প্রতি স্টপে বাস থেকে নামলেই মন্দির, ভেতরকার অলিগলির কথা বাদই দেয়া যাক। এই বাড়বাড়ন্তের কারন যে তোলা আদায় চাঁদার নামে আর সাপ্তাহিক প্রনামীর হিস্যা নেয়া, এককথায় অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া সেটা না বললেও সবাই জানে। তবু ঘটা করে বাতাসা নকুলদানা শসা সহযোগে পুজো দিতে যাবার উৎসাহে ঘাটতি নেই মানুষের।  তার ওপর মন্দির একটা খাড়া করে দিলেই হল, তারপর তার চারপাশে আস্তে আস্তে জমি দখল চলতেই থাকে বছরের পর বছর ধরে, সেইসাথে পুকুরপাড়ে মন্দির হলে পুকুর বোজানো এসবই চলে প্রকাশ্য দিবালোকে, প্রশাসনের নাকের ডগায় তবু তারা থাকে সম্পূর্ণ উদাসীন। 

পাড়ার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমাদের ওপরতলায় থাকতেন পরিমল দাশ, খুব সম্ভব গণশক্তির সম্পাদক ছিলেন এক সময়। বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন তার ওপর কট্টর কম্যুনিস্ট, এদিকে চারদিকে তখন সিপিএম ছেয়ে রয়েছে আশির শেষের দিকের কথা। এই পরিস্থিতিতে সরস্বতী পুজোর চাঁদার জন্য আমাকে পাঠানো হল ওনাদের ফ্ল্যাটে। কী চাই বলতে উনি পত্রপাঠ জবাব দিলেন "আমি চাঁদা দিইনা"। পরে জানলাম উনি কোন পুজোতেই দেননা চাঁদা। পাড়াতেও সব সিপিএম, যারা চাঁদা তুলতে যেত তারাও, তবু মার্ক্সীয় দর্শন মেনে পুজোর চাঁদা না দেয়ার জন্য আড়ালে গালিগালাজ করতে দ্বিধাবোধ করতনা। মার্ক্স মশাই যদিও বলে গেছেন শ্রেণীহীন মানুষ রাতারাতি ধর্মকে ত্যাগ করবেনা বরং সেটা আসবে সময়ের বিবর্তনের সাথে, সেদিক থেকে দেখলে এই দু নৌকায় পা রেখে চলাটা অস্বাভাবিক কিছু না কিন্তু এই একটা ঘটনা থেকেই বোঝা যায় যে ধর্মের শিকড় আমাদের মানসিকতায় এতটাই গভীরে যে বামপন্থী আন্দোলনের ঢেউও এই জগদ্দল প্রতিষ্ঠানে চিড় ধরাতে পারেনি। 

এই দেবদেবীর লিস্টির ওপর থাকবে দলে দলে বাবা আর গুরুদেবের দল রাম ঠাকুর অনুকুল ঠাকুর লোকনাথ। এঁদের বেশীরভাগই আবার গৃহী মানুষ তাই অনেকের কাছে এদের কদর প্রচুর এই কারনে যে আর পাঁচটা লোকের মত সংসার করেও আধিদৈবিক ক্ষমতা থাকতে পারে এই বিশ্বাসে। অন্যদিকে এই বাবাদেরও পোয়াবারো ঘরকন্না করে গাছেরও খাচ্ছে আবার আম জনতাকে টুপি পরিয়ে কলাটা মুলোটা নিয়ে তলারও কুড়োচ্ছে। খোদ আমার কেমিস্ট্রি স্যার, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মান্ড যার কাছে ১০৫ টা মৌল আর প্রোটন-ইলেকট্রনের খেলা তাঁরও একখানি গুরুদেব ছিল যিনি কিনা আবার কোন দুঃস্থ মানুষের বিয়েতে আকাশ থেকে রাশি রাশি ছানাবড়া হাজির করেছিলেন। এই বিশ্বাসকে বিজ্ঞান টলাবে কেমন করে? এখন কেবল টিভির দৌলতে লোকজন খালি বাঙালী ঠগবাজদের কবলেই নয়, দেশজোড়া জোচ্চোরদের খপ্পরে পড়েছে সে রবিশঙ্কর ই হোক বা বাবা রামদেব ই হোক, রেহাই কোনভাবেই নেই। তাছাড়া রয়েছে হাজারো ওঝা-পীর-বদর-জলপড়া-তেলপড়া-তান্ত্রিক-কাপালিক-ঝাড়ফুঁক-তাবিজ-মাদুলি রক্তবীজের দঙ্গল। 

এ তো গেল নিচ্ছে কারার দলের গল্প। দেখা যাক দিচ্ছে কারা এবারে (যদি দিচ্ছে কারা আর নিচ্ছে কারার সাথে আলাপ না থাকে ধরে নিন শোষক আর শোষিতের তফাত)। আশি নব্বইতে কমিউনিজমের চক্করে পড়ে বাঙালীর ধার্মিক সত্ত্বা টলোমলো। একদিকে হাজার হাজার বছরের বস্তাপচা হিন্দুধর্মের রীতিরেওয়াজ, না মানলে সমাজচ্যুত হবার আশঙ্কা, অন্যদিকে মার্কসের দর্শনে ধর্ম মানুষের আফিম, দৈনন্দিন সমস্যা থেকে নজর ঘোরানোর সস্তায় পুষ্টিকর খাদ্য ধর্ম। ধর্ম মানলে আবার লোকাল কমিটির চোখরাঙানি পার্টি থেকে বার করে দেবার। যাঁরা কমিউনিজমের সমর্থক নন তাঁদের এই টানাপোড়েনটা ছিলনা তবু বাকী অন্যান্য সমস্যাগুলো সবারই কমবেশী সাক্ষাৎ হয়েছে। 

বাঙালি সাহিত্য সঙ্গীত লোকাচারে ধর্মের উপস্থিতি অনস্বীকার্য।  রবীন্দ্রনাথের পুজা পর্যায়ের লেখাগুলোতে ঈশ্বরচিন্তার প্রাচুর্য থাকলেও সেই ঈশ্বরচিন্তা যে "ভগবান আমার অম্বলটা সারিয়ে দাও সামনের পুজোবারে হরির লুট দেব" জাতীয় চিন্তা নয়, বরং ঈশ্বরকে নিজের মনের মধ্যে খোঁজার চেষ্টা ছিল প্রকট। কিন্তু সে জাতীয় আধ্যাত্মিক বিশ্লেষন না করে আপাতদৃষ্টিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাথে ভগবানের একটা যোগসাজস খুঁজে বেড়ানোই আমাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া রয়েছে শ্যামাসঙ্গীত রামপ্রসাদী কীর্তন জাতীয় বিভিন্ন উপাদান যেগুলো সময়ের সাথে হাতবদল হয়ে আসছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। সাহিত্য আর ঐতিহাসিক কারনে এগুলি অমূল্য হলেও লোকে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে, দেখে ধর্মের প্রতীক রূপে। ক্রিটিকাল চিন্তাভাবনা যা মানবজীবনের বিবর্তনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, সেই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এই সৃষ্টি কৃষ্টিগুলোকে বিশ্লেষণ করার চেয়ে আমরা গতানুগতিক রয়ে গিয়েছি এগুলোকে দৈববাণীর মত অমোঘ ভেবে নিয়ে কারন সেখানে নেই সব চিরাচরিত ধ্যানধারনাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন ভাবে গড়তে বসার অনিশ্চয়তা। 

এরপর যে দুই ব্যক্তির কথা উল্লেখ করবো তা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্কই হতে পারে। বাঙালি জীবনে তাঁদের প্রভাব যে প্রশ্নাতীত সে নিয়ে কোন দ্বিমত নেই কিন্তু সেই প্রভাব ইতিবাচক কিনা সে নিয়ে তেমন কোন আলোচনা কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছেনা। এই দুই ব্যক্তি হলেন রামকৃষ্ণ আর বিবেকানন্দ। আমরা কিছু কিছু মানুষকে প্রায় ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে রেখেছি সর্বশে্রষ্ঠ বাঙালী হিসেবে, তাঁরা সকল সমালোচনা বা যুক্তি-তর্কের ঊর্দ্ধে। এঁদের কাজকর্ম বা অবদান নিয়ে প্রশ্ন তুললেই সব স্থান-কাল-পাত্র ভুলে জোট বেঁধে রে রে অর্বাচীন বলে তেড়ে আসে। এটা শুধু বাঙালীদেরই ব্যাপার না, বীরপুজোর চল সব জায়গায়ই বজায় আছে তা সে মুসলমানদের মহম্মদ নিয়ে হোক বা ফরাসীদের নাপোলেয়ন, বৃটিশদের চার্চিল-থ্যাচার। আমাদেরও সেরকম রয়েছে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথ নেতাজি সত্যজিৎ। বাঙালী বলে এঁদের নিয়ে গর্ব করেই ক্ষান্তি নেই, এঁদের সমালোচনা হল রাজদ্রোহের সামিল। সাধারন বাঙালী ঘরে দেয়ালে আর কিছু না থাকুক একটা রামকৃষ্ণ বা বিবেকানন্দের ছবি টাঙানো থাকে, তাঁরা অর্ধেক দেবতা রূপে পুজাও পান। বিবেকানন্দ রচনাবলী আমার পড়া হয়নি তাই বেশীরভাগ তথ্যই বিভিন্ন মাধ্যমে কোন এক সময়ে দেখা বা পড়া। বিবেকানন্দ রচনাবলী উনিশশতকে লেখা বাঙালির self-help বা chicken soup জাতীয় বই। সেদিক থেকে এর গুরুত্ব বা সুফল অনেক বিশেষ করে আত্মনির্ভর হবার জন্য। চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রেও বিবেকানন্দের লেখা অনুপ্রেরনা যোগায়। কিন্তু অন্যদিকে তাঁর আদর্শ সমাজে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ছাপ প্রকট, অন্যান্য জাতি ধর্মের মানুষ এই সমাজে থাকবে বটে কিন্তু সমাজগঠনে তাদের কোন ভুমিকা নেই, হিন্দুরা থাকবে ত্রাতার স্থলে। বিবেকানন্দের আদর্শ সমাজে মেয়েদের স্থান নিয়েও প্রশ্ন জাগে। মেয়েদের সমাজ তৈরিতে কিছু নির্দিষ্ট কাজ ঠিক করে দিয়েছেন কিন্তু পুরুষদের মহিলা সান্নিধ্য থেকে যতটা সম্ভব দুরে রাখা যায় সেই উপায়ও বাতলে গেছেন। সময় এবং স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রস্তাবগুলো দৈনন্দিন জীবনে প্রযোজ্য ছিল কিন্তু আধুনিক জীবনেও সেই মতাদর্শগুলোকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা যে গোঁড়ামো তা বলার অপেক্ষা রাখেনা কিন্তু এই মতবাদগুলোর সমালোচনা করারও যে জায়গা নেই সমাজে  সেটাই আক্ষেপের। সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কেউ যদি প্রশ্ন তোলে বিবেকানন্দের মতবাদ বা প্রতিপাদ্যগুলো বর্তমান বাঙালী জীবনে কতটা প্রাসঙ্গিক তাহলে তাকে বেয়াদব বলে কাঠগড়ায় না দাঁড় করিয়ে যদি প্রতিবাদ করতে হয় তবে যুক্তি তর্কের সাহায্যে নস্যাৎ করাটাই পরিনত মানসিকতার পরিচয়। আত্মীয়পরিচিত অনেকেই মিশনের সদস্য তাদের থেকেই জানা যায় কীভাবে মিশন তাদেরকে কীরকম মগজধোলাই করেছে। 

লেখার শুরু করেছিলাম বাঙালী জীবনে ধর্মকর্ম এবং আধ্যাত্মিকতার চল নিয়ে, যেখান থেকে অনেকটাই সরে এসেছি। একবার দেখে নেওয়া যাক সাধারন জীবনে এই দুইয়ের প্রভাব কতটা। আধ্যাত্মিকতা তো বহুদিন আগে লোপ পেয়েছে, তার গন্ডি সীমিত একটা শ্রেনীর মধ্যে। তার বাইরে যেটা বর্তমান তা হল বিভিন্ন রূপকের মাধ্যমে ধর্মীয় আচারের অন্ধ অনুকরন। সেই অনুকরনে আজও চলতে থাকে কুমারী পুজা, বলি, বারবণিতার দোরের থেকে মাটি নেওয়া, কন্যাদান ইত্যাদি মধ্যযুগীয় প্রথা। মানুষও পরম্পরার নামে এই আচারগুলো মেনে নিয়ে চালিয়ে যাবার পক্ষে, সময়ের সাথে ধর্মেরও খোলনলচে না বদলালে তা মানুষের অগ্রগতির সহায়ক না হয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেটা জেনেও কেউ তা পাল্টানোয় উদ্যোগী নয়। এখনও সেই "What Bengal thinks today, India will think tomorrow" জাতীয় কথা ভেবে নিজেদের শ্রেষ্ঠতার বড়াই জারী আছে কিন্তু তার কোন ছাপ ধর্মীয় পরিমণ্ডলে নেই, সেখানে রয়েই গেছে গতানুগতিকতা বাকী ভারতের মত।  তাই ধর্ম মানে এখনও সকালবেলায় লক্ষ্মী কালী সহ সব দেবদেবীকে প্রনাম ঠুকে বাড়ি থেকে বেরনো, নতুন গাড়িতে পুরোহিতের স্বস্তিক আঁকা, আলতা সিঁদুর শাঁখা পলা, বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা, দশকর্মা ভান্ডার, শনি মঙ্গল কালী বৃহস্পতিতে লক্ষ্মীপুজা, কালীপুজার চৌদ্দপ্রদীপ আর বাজি পোড়ান – বেশীরভাগটাই রূপকের মধ্যে দিয়ে যা জন্ম থেকে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে জীবনের অঙ্গ হিসাবে জুড়ে যায় তাই সেই নস্টালজিয়ার ধোঁয়াশার বাইরে নতুনভাবে ভাবার, সব ঘেঁটে দিয়ে আবার শুন্য থেকে শুরু করার ইচ্ছা আর চেষ্টা কোনটাই সহজ নয়। একইভাবে ঈশ্বরও আমাদের কাছে এক প্রতীকমাত্র, প্রনাম ঠুকেই যার প্রতি আনুগত্য শেষ। সব বুজরুকি বলে মূর্ত্তিগুলোকে টান মেরে ফেলেও দিতে পারিনা আবার ঈশ্বরকে এই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে রেখে যে আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে তাতেও আগ্রহ নেই, কেবল আছে বিভিন্ন আচারবিচার কুসংস্কার ইত্যাদির বাহুল্যে গা ভাসানো। 

যে কোন জাতির অগ্রগতি নির্ভর করে সময়ের সাথে সার্বিক জ্ঞানের উন্মেষে যা মুক্ত চিন্তার চাবিকাঠি আর সেটা আসে শিক্ষা এবং সমাজ সচেতনতা থেকে। সাধারন বাঙালী জীবনে এর কোনওটারই অভাব নেই, যা নেই সেটা হল সেই জ্ঞান সংশ্লেষ করার আগ্রহ। যারা কলেজজীবনে গরু খেয়ে প্রমান করতে চেষ্টা করে তারা ধার্মিক নয় তারাই আবার এক দশক বাদে অষ্টমীতে নতুন পাঞ্জাবি বা শাড়ি পরে অঞ্জলির জন্য লাইন লাগায় কিন্তু এই দুটি বিপরীত মেরুর কোনটাই দৃঢ়সঙ্কল্প হয়ে নয় আর সেটাই আধ্যাত্মিকতার চেয়ে ধর্মকে বেশী প্রাধান্য দেবার ফল। আত্মানং বিদ্ধি কথাটা যা দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম তা যদি দৈনিক জীবনের অঙ্গ হতো তবে মানুষ খানিকটা হলেও নিজেকে জানার চেষ্টা করতো আর জীবনের এই বিভিন্ন প্রশ্নগুলোর উত্তর না জানলেও কোন পথে সেই খোঁজ শুরু করবে সে সম্বন্ধে ওয়াকীবহাল থাকতো। 

বাঙালীর সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক উৎকর্ষের সেই ঊনবিংশ বিংশ শতাব্দী এখন বিগত। এই নতুন শতকের প্রজন্ম পুরনো ঐতিহ্যের তেমন অন্ধ অনুকরন করেনা। ইন্টারনেটের যুগে তথ্যের উপর ভিত্তি করে যুক্তি দিয়ে বিচার করার প্রবনতা অনেক বেড়েছে। এরা আবেগে গা ভাসিয়ে "আমার পুরনো স্কুল পুরনো বাড়ি পুরনো পাড়ার পুরো শহর" এই জাতীয় নস্টালজিয়ায় না ভুগে জীবনে এগিয়ে চলাকেই মুলমন্ত্র হিসাবে বেছে নিয়েছে। মুক্ত স্বাধীন চিন্তার বিকাশ যা পশ্চিমী সভ্যতার মুল ভিত্তি সেটা আজকের বাঙালি সংস্কৃতিতেও বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। তবে পূর্বের ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক পটভূমিতে পশ্চিমের অন্ধ অনুকরন যেমন সর্বনাশা হতে পারে, তেমনই পশ্চিমী চিন্তাধারার সুফলগুলো থেকে অনুপ্রেরনা নিয়ে নিজের জীবনে তা প্রয়োগ করলে ধর্ম, জাতপাত, বৈষম্য এজাতীয় অনেকক্ষেত্রেই জীবনবোধ সঙ্কীর্ণতার গন্ডি পেরিয়ে অনেক উদার হবার সম্ভাবনাও রয়েছে। তফাত শুধু কোন চিন্তাগুলো গ্রহন করা হবে আর কী পরিমানে তার ওপর। তবে এটা আশা করা যেতেই পারে যে, যেমন পশ্চিমী সভ্যতা পূর্বের ধ্যানধারনার সাথে নিজেদের আঞ্চলিক সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সম্মেলন ঘটিয়েছে, একইভাবে সেই পশ্চিমী চিন্তাধারা ও জীবনদর্শন আমাদের ধর্মীয় গোঁড়ামি আর কুসংস্কারের জাল কাটিয়ে নিজেদের গভীরভাবে জানতে সাহায্য করবে। আর জোর করে কুইনিন গেলানোর মত ধর্ম বা নাস্তিক্যবাদকে স্থাপনা করে নয়, সেই নিজেকে জানার মাধ্যমেই আসবে উত্তরন। কতদিন লাগবে তা হতে? ভগবান জানে...থুড়ি, কেউ জানেনা।