Showing posts with label Bengalis in business. Show all posts
Showing posts with label Bengalis in business. Show all posts

Thursday, 16 April 2015

চাঁদ সদাগর এবং বাঙালির বানিজ্যচর্চা : অতীত ও বর্তমান

এই লেখাটা নেহাতই দুয়ে দুয়ে পাঁচ করার চেষ্টা ক্ষনিকের অবসর সময়ে, এর মধ্যে বিন্দুমাত্রও ঐতিহাসিক গবেষনা নেই। বানিজ্যে বসতে লক্ষ্মী কথাটা আগে ভাবতাম বাংলা আর তার মানে বানিজ্য করতে লক্ষ্মীর সাহায্য চাই। আধুনিক যুগে বাঙালির দুর্নাম আছে ব্যবসায় আমাদের তেমন সাফল্য নেই, সফল বাঙালি অঁত্রপ্রেনর হাতে গোনা গুটিকয়, বাকী ভারতের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। শিল্প আর বানিজ্যে সফল হতে গেলে সবার আগে যা দরকার সেটা হল আত্মবিশ্বাস আর স্থানীয় সরকার/প্রশাসনের সাহায্য। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের একটা লিস্ট আছে কোন দেশে ব্যবসা করা কত সোজা, তাতে ভারত বাংলাদেশ দুয়েরই স্থান একদম তলানিতে। তবু বাকী ভারতে ব্যবসায়ীর প্রাচুর্যের মুল কারন হল আত্মবিশ্বাস যেটা এসেছে ব্যবসাকে সামাজিক সাফল্যের চাবিকাঠি হিসাবে ধারনা করা থেকে। যার ফল হল বিপুল সংখ্যক স্বাধীন ছোট আর মাঝারি শিল্পবানিজ্য, যা মুলত কৃষিপ্রধান দেশ হলেও, ভারতীয় অর্থনীতিতে এক বড় অবদান রেখে চলেছে। এই চরম ডারউইনিয় পরিবেশে ব্যবসার সাফল্য এতটাই সুবিদিত যে জুগাঢ় শব্দটা কয়েক বছরের মধ্যে অক্সফোর্ড শব্দকোষে ঠাঁই পেলে অবাক হব না। অন্যদিকে বাঙালি সমাজে ব্যবসার স্থান নিতান্তই ব্রাত্য, পেশা হিসাবে ব্যবসাকে গ্রহন করা মানে সামাজিক হারাকিরি। পাত্রী চাই তে বিজ্ঞাপনে যদি থাকে পাত্র ব্যবসায়ী তবে সে অবিলম্বে রিজেক্ট। আর যদি বলে পাত্রী ব্যবসায়ী ওরেব্বাবা সেটা তো কেলেঙ্কারি কান্ড। বালাই ষাট, বেঁচে থাকুক সরকারী ছাপোষা কেরানীগিরি, ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ারগিরি আর উকিল ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার। নেহাতই ফেল্টুমার্কা গবেট না হলে কেউ ব্যবসা করে? 

ব্যবসাক্ষেত্রে বাঙালির এই নিদারুন পরিস্থিতির কারন বিশ্লেষন করতে গেলে একটা ব্যাপার খুব পরিস্কার, এখানে সামাজিক মানসিকতা ব্যবসার পরিপন্থী। ব্যবসা এখনও গর্ব করার মত জীবিকা নয় আর ঠিক সেই কারনেই লোকে আবেগ দিয়ে ব্যবসা করেনা। মিষ্টির দোকান থেকে মুদিখানা, একটা প্যাটার্নই চোখে পড়ে যে এরা প্রবলভাবে গতানুগতিক, যখন ব্যবসা শুরু করেছে তখন থেকেই সময় দাঁড়িয়ে গেছে এদের জন্য। তবে এই হালের জন্য যারা ব্যবসা করছে তাদের যদি দায়ী সাব্যস্ত করি তার চেয়ে বেশী ভুল আর হতে পারে না, সমস্ত প্রতিকুলতার মধ্যেও যে এরা বাকী সবার চেয়ে আলাদা হবার সাহস দেখিয়েছে তার জন্য কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। সমস্যাটা সম্পূর্ণ অন্য। 

একটু মাইকেল জ্যাকসনের মুনওয়াকের মত পিছন দিকে হাঁটা যাক। প্রাচীন কালে, সন তারিখ জানা নেই যদিও, আর ক্ষণেক্ষণে উইকিপিডিয়া খোলারও ইচ্ছে নেই, তাই প্রাচীন কালটাই রাখলাম...বাঙালি তখন ব্যবসাসুত্রে মালয় সুমাত্রা অবধি চষে ফেলেছে। চাঁদ সদাগর আদপে কোন বাস্তব মানুষ ছিল কিনা জানা নেই কিন্তু যে কোন সাহিত্য তৎকালীন সমাজের যে প্রতিফলন থাকে তা অনস্বীকার্য, তাই চাঁদ সদাগরের বানিজ্যযাত্রার বিবরনে যে খানিকটা সত্যি আছে তা বলাই যেতে পারে। সেই সময়ের পর থেকে বঙ্গ বহু ভিনদেশী শাসকের হাতে পড়েছে যেটা স্বাধীন চিন্তার বিকাশে বিঘ্নই নয় সমস্ত জাতীর স্বাধীনচেতা মনোভাবের সম্পূর্ণ বিলোপ ঘটিয়েছে বহু শতক ধরে। কোন তথ্যপ্রমাণ নেই তবু আন্দাজ করে নেয়া যেতেই পারে যে সেই প্রাচীন যুগের উৎসাহী উদ্যমী ব্যবসায়ীকুলের অর্জিত অর্থের প্রায় অনেকটাই যেত এইসব ভিনদেশী শাসকদের কোষাগারে। তাই সময়ের সাথে সাথে বানিজ্য করতে আয়ের চেয়ে ব্যয় হত বেশী, ফলে ব্যবসা করাটা আর তেমন আকর্ষণের রইলনা বাঙালি বণিকদের কাছে। বরং শাসকদের তাঁবেদারি করে তাদের লুঠের ছিটেফোঁটা প্রসাদ পাওয়া হয়ে উঠল অনেক সুবিধাজনক। দশের থেকে আলাদা হয়ে শাসকদের বিরাগভাজন হওয়া ছাড়া বানিজ্যের আর তেমন কোন গুরুত্ব রইল না। 

ব্রিটিশ শাসনের সময় এক নতুন মাত্রা যোগ হল এই ব্যবসায়িক নিরুৎসাহে। অনুশাসনের খরচ কমানোর জন্য তৈরী করা হল এক ইংরাজী শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী। ঔপনিবেশিকতার একটা সুফল হিসাবে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করে যে জ্ঞানের ওপর যে ইউরোপীয় দখলদারী ছিল সেই জ্ঞান ঔপনিবেশিত দেশগুলোতেও বিস্তৃত হল কিন্তু আদপে সেই শিক্ষাব্যবস্থার মুল উদ্দেশ্য ছিল সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণী স্থাপন যা স্বাধীন চিন্তার বিকাশে বাধা দেবেনা কিন্তু তৈরী করবে কিছু বাঁধাধরা মূল্যবোধ বিশিষ্ট এক সমাজ যেখানে সমাজ থাকবে চালকের আসনে। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সেই মূল্যবোধের পরিপন্থী হলে সে সমাজ থেকে ব্রাত্য। সেই যে পরম ক্ষমতাবান বসের হয়ে কলম পেষাকে বাঙালি জীবনের চরম লক্ষ্য করে দেখানো শুরু হল, সেই ট্র্যাডিশন আজো সমানে চলিয়াছে। সেই দর্শনে স্বাধীন চিন্তায় নিজেই নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা হওয়া, ব্যবসায় যার প্রয়োজন সবার আগে আত্মবিশ্বাস যোগানোর জন্য, তার কোন স্থান নেই। 

দেশ স্বাধীন হবার পর সাপের পঞ্চম পদের আবির্ভাব হল। সামাজিক নীতি পুলিশের চোখ রাঙানি পেরিয়ে যদিবা কেউ শুরু করল এক নতুন ব্যবসা, এরপর দোসর হিসাবে জুটল বখরা নেবার দল। ব্রিটিশ প্রশাসনিক কাঠামো একই রয়ে গেল, খালি মানুষগুলো পাল্টে এল কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত ঘুণধরা লাজলজ্জাহীন প্রশাসকের দল। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে পাড়ার মস্তান, আইএএস আমলা থেকে ঠিকাদার, এই এক ক্ষেত্রে সবাই সমান ভাগ বাঁটোয়ারা করে লুটছে বখরা নিয়ে কোনো দ্বন্ধ নেই। ফলে ব্যবসা করার দ্বিতীয় অন্তরায়টিও ষোল কলায় পূর্ণ হল স্বাধীনতার পর। নব্বইয়ের দশকে নরসিমা রাও সরকারের অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর প্রচুর বিদেশি সংস্থা ভারতে ব্যবসা করতে আসার পর বানিজ্যিক চিন্তাধারার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে গত ২৫ বছরে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের শিল্প বানিজ্যের দৈন্যদশা কাটেনি। সিপিএম বরাবর বিদেশি লগ্নির বিরোধিতা করে এসেছে, তার ওপর সিটু, বনধ ইত্যাদির জন্য সরকার আগ্রহী হলেও যে এই চিত্রটা বদলাত তা বলা দায়। সিপিএম জমানার শেষের দিকে কিছু লগ্নি এলেও, বাকী ভারতের তুলনায় সেটা নগণ্য।  ফলে দেশের অন্য কোনে যখন বিদেশি সংস্থাগুলোর বাড়বাড়ন্ত, পশ্চিমবঙ্গে তখন একের পর এক শিল্পে লালবাতি জ্বলেছে। অর্থনৈতিক উদারীকরণ বিদেশি সংস্থাগুলোকে অনেক সুযোগসুবিধা করে দিলেও আঞ্চলিক ব্যবসায়ীরা কতটা সুফল পেয়েছে বলাই বাহুল্য। তাদের নতুন ব্যবসায় উৎসাহী করতে প্রশাসন যেমন ব্যর্থ তেমনই ব্যর্থ আমাদের জড়দ্গব বাঙালি সমাজ। ব্যবসা করতেও যে বুদ্ধির দরকার পড়ে বিশেষ করে যেখানে প্রতিটা বিবেচনার আগে চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণের প্রয়োজন সেখানে সামাজিক অসাফল্যের তকমা লাগিয়ে দেয়াটা বাঙালি সমাজের অসারতা আর কূপমণ্ডুকতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে। 

এর মধ্যে ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। অনেক উদ্যমী বাঙালিই স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সফল হয়েছে সুব্রত রায় থেকে পূর্ণেন্দু চ্যাটার্জি, পিয়ারলেস গ্রুপ থেকে সাধন দত্ত পর্যন্ত। আবার অমর বোসের মত বাঙালিরাও আছে সেই লিস্টে কিন্তু তাঁদের ব্যবসার মূল ক্ষেত্র বাংলা বা ভারতের বাইরে। এঁদের সাফল্যকে বিন্দুমাত্র খাটো না করেও একটা ব্যাপার লক্ষনীয় যে অধিকাংশ সফল বাঙালি ব্যবসায়ী বা অঁত্রপ্রেনররা কর্মজীবন শুরু করেছে ইঞ্জিনিয়ার বা অন্যান্য আপাতদৃষ্টিতে সমাজগ্রাহ্য জীবিকায়। ফলে সাধারনের চোখে পেটে বিদ্যে আছে সুতরাং এঁরা ভাল লোক, বাকী ব্যবসায়ী মানেই অসৎ লোক ঠকানো, সেই ধারণার কোন পরিবর্তন হয়নি। 

যে ভাবনা থেকে লেখাটা শুরু করেছিলাম সেখানেই ফিরে যাই। চাঁদ সদাগরের উল্লেখ আগে একবার করেছিলাম, আবার মনে করি বেহুলা লক্ষীন্দরের উপাখ্যান কিন্তু এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। রূপক গুলোকে আজকের আলোকে দেখলে চাঁদ সদাগর এক দুর্দম বণিক, অন্যদিকে মনসা লোকাল মস্তান, তার এলাকায় তোলা না দিয়ে চাঁদ সদাগরের ব্যবসা চলবেনা। সম্ভ্রমের দরকার তার নেই, ঘৃণাভরে বাঁ হাতে ছোঁড়া ফুল হলেও সেটাই তার চাই, যেমন আজকের দিনে ট্রাফিক পুলিশ কুড়িয়ে নেয় ট্রাকওলাদের ছুঁড়ে দেয়া খুচরো পয়সা। না দিলে কারবার বন্ধ, ফলে ভেঙে দাও বানিজ্যতরী, মেরে ফেল পরিবারকে, যতক্ষন না তোলা আদায় হচ্ছে চালিয়ে যাও জুলুম। চাঁদ সদাগর চরিত্রের চরম আকর্ষণ এখানেই যে সে ভেঙে না পড়ে বরং মনসার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল, অনেকটা প্রমিথিউসের স্বর্গ থেকে আগুন চুরির মতই প্রতিষ্ঠানের সরাসরি বিরোধিতা। বারবার মনসার প্রতিশোধ সত্ত্বেও সে বানিজ্যকে দাঁড় করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এই হার না মানা উদ্যোগী মনোভাব একদিকে যেমন তার লড়াকু স্বভাবের প্রমাণ তেমনি প্রমাণ তার বানিজ্যে পারদর্শিতা, বিরূপ পরিস্থিতির বিরূদ্ধে বারংবার পরিবর্তন, শুন্য থেকে শুরু করার ক্ষমতা যা একজন সফল ব্যবসায়ীর মূলমন্ত্র। 

বহু শতাব্দী আগের এই উপাখ্যানে একজন দক্ষ ব্যবসায়ীর চারিত্রিক গুনগুলো তুলে ধরা হয়েছিল, আজকের দিনে সেগুলো লুপ্তপ্রায়। এই যুগ হল আপস করে চলার, এক উলঙ্গ রাজার রাজত্ব — কাপড়ের খোঁজ করলেই গর্দান। স্বাধীন ব্যবসার মুল অন্তরায়গুলি দিনে দিনে হয়ে উঠছে সবলতর, ফলে চাঁদ সদাগরের মত আইকনোক্লাস্টরা রয়ে যাচ্ছে বইয়ের পাতায়, আর বাঙালির ব্যবসাবুদ্ধি গিয়ে ঠেকেছে  নোনাধরা দেয়ালে টাঙানো লক্ষ্মী গণেশের ছবিতে সিঁদুর লাগানোয়। হয়তো কোন এক দিন, সুদুর ভবিষ্যতে মুছে যাবে এই সব ঠুনকো সংস্কার, মানুষ পরিচিত হবে তার কৃতির দ্বারা, জাতি-গোত্র দিয়ে নয়, সব জীবিকাই যে সমান গুরুত্বপূর্ণ সেটা পাখি পড়া করাতে হবেনা আর…সেদিন হয়তো দেখা যাবে যে বাঙালিরা অতীতের রোমন্থন না করে ভবিষ্যতের দিকে ফিরে তাকিয়েছে, আর বাঙালি কেবল বিভিন্ন এন্ট্রান্স পরীক্ষার পেছনে না দৌড়ে স্বাধীন স্বাবলম্বী ব্যবসায় মনোযোগ দিয়ে সফল হচ্ছে আর সারা ভারতে তাদের বহুমুখী প্রতিভার জন্যেই পরিচিত হচ্ছে, শুধু শিক্ষাবৃত্তির জন্য নয়।