আমি ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক একদম ছোটবেলা থেকেই। উদ্বাস্তু পরিবারে জন্ম, বাঙাল আচার বিচার জীবনধারায় বড় হয়েছি, তাই ইস্টবেঙ্গল ছাড়া যে অন্য কাউকে সমর্থন করা যায় সেকথা কখনও মাথায়ই আসেনি। তারপর যত বড় হয়েছি যুক্তি তথ্য ইত্যাদি দিয়ে নিজের সব পছন্দ অপছন্দ গুলোকে আবার ঝালিয়ে নিতে হয়েছে। সেই নিক্তিতে পছন্দ অপছন্দের লিস্টিটারও অনেক অদলবদল হয়েছে। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের থেকে সমর্থন তুলে নেবার কথা কখনও মাথায়ই আসেনি, যতই সে ইপিএল বুন্দেসলিগা ইউএফা কাপের তাবড় তাবড় খেলুড়েরা টিভির পর্দায় কেত মারুক না কেন। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব হলো ঘুরে দাঁড়ানোর নাম। ইস্টবেঙ্গলের সাথে জুড়ে আছে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু মানুষের লড়াই করার ইতিহাস। যদিও এখন যুগের ধর্ম মেনে আদ্ধেক খেলোয়াড়ই বিদেশী, তার মানেই যে দলের আদর্শ পাল্টে গেছে তা তো নয়। তার ওপর বন্ধুর দাদু ছিলেন ইস্টবেঙ্গলের ডাকসাইটে খেলোয়াড়, পাড়ার আরেক বন্ধুও খেলেছে ইস্টবেঙ্গলে, সেই সূত্রে ইস্টবেঙ্গলের সাথে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেছিলো অনেক দিনের।.এখন বহুদিন মাঠে গিয়ে খেলা দেখিনা, তবু মোহনবাগানের কদিন আগে ইস্টবেঙ্গলের সাথে খেলা থাকলেই আবার ফিরে যাই কুড়ি পঁচিশ বছর আগে। তা কদিন আগেই দেখলাম দাদাগিরি নামের অনুষ্ঠানে নাকি কেউ একজন বাঙালদের নিয়ে অনেক কুরুচিকর মন্তব্য করেছে আর সৌরভ গাঙ্গুলী তাতে বাধা না দিয়ে আরো হাসাহাসি করেছে। এই নিয়ে ইস্টবেঙ্গলের ফেসবুক তোলপাড়। কেউ দাদার মুণ্ডপাত করছে তো কেউ সেসব ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের যারা ওই শোতে উপস্থিত ছিল। তোলপাড় হচ্ছে ইন্টারনেট, হওয়াটা দরকার, কিন্তু এপার বাঙলা ওপার বাঙলার রেষারেষির ভূমিকাটা জানা প্রয়োজন।
একশ বছর আগে বাঙালদের প্রতি বিদ্বেষমূলক ব্যবহার ছিল হয়তো দৈনন্দিন ঘটনা। আর সেভাবেই সৃষ্টি ইস্টবেঙ্গল দলের। ১৯২০ সাল থেকেই ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান ম্যাচ তাই ঘটি বাঙালের দ্বন্ধ হয়ে দাঁড়ালো। আওয়াজ টিটকারি ব্যঙ্গ বিদ্রুপ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসবের লক্ষ্য ছিল বাঙালরা। দেশভাগের পর ভিটেমাটিছাড়া মানুষরা যখন পশ্চিমবঙ্গে এলো, তখন তাদের বেশিরভাগেরই এসেছে খালি হাতে। সরকার থেকে পুনর্বাসন মেলে কলকাতার শহরতলিতে যেখানে তখন জলাজমি ছাড়া আর কিছুই ছিলোনা। এক চিলতে জমি, সেখানে রোদ ঝড় জল মাথায় করে, দিন আনি দিন খাই করে শুরু হয়েছিল সেই মানুষগুলোর ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। কোনোদিন কেউ কিছু পাইয়ে দেয়নি তাদের। নিজের সামর্থ্য আর একরাশ স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই সহায় ছিলোনা তাদের। বাকিটা ইতিহাস। বাঙাল মানেই টিঁকে থাকার লড়াই, উদ্যম অধ্যবসায়, পায়ের তলায় জমি খুঁজে নেয়ার উদগ্র প্রচেষ্টা।
কিন্তু সেই অসম্ভব একরোখা মনোভাবের মানুষেরা যখন পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করা শুরু করলো, তখন প্রথম প্রথম সম্পর্কটা আদায় কাঁচকলায় হলেও এপার বাঙলার মানুষরা মেনে নিয়েছে বাঙালদের। আস্তে আস্তে ঘটি হেঁশেলঘরেও ঢুকে পড়েছে কচুর লতি, পুইঁশাক আবার তেমনি বাঙালরাও রান্নায় জুড়তে শিখেছে খানিক চিনি। ঘটি বাঙাল বাড়ির মধ্যে বিয়েও আজ হামেশাই হয়, কেউ সেটা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনা। ইস্টবেঙ্গলে ঘটি খেলোয়াড় খেলে যেমন মোহনবাগানে খেলে বাঙাল প্লেয়ার। নিমরাজি হয়েও, খানিক চাঁদ সদাগরের মনসা পুজোর মতো ঘটিরা জায়গা করে দিয়েছে বাঙালদের তাদের দৈনন্দিন জীবনে। উড়ে এসে জুড়ে বসা মানুষগুলোর ওপর তারা চড়াও হয়নি রাজাকারদের মতো। আমার আগের প্রজন্ম দুই তরফেই বাঙাল, তাদের জীবনে প্রথম স্থায়িত্ব আসে পশ্চিমবঙ্গে আসার পর। তাদের বাকি জীবন পশ্চিমবঙ্গে নির্ভয়ে নির্দ্বিধায় কাটাতে পারার জন্যে এই ঘটিদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কৃতিত্ব তৎকালীন সরকারের অবশ্যই, কিন্তু যার যতটুকু যোগ্য কৃতজ্ঞতা সেটা স্বীকার করাটাই যথার্থ।
তাই এই রেষারেষি, ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেয়া ঘটি বড় না বাঙাল, এ সবই খানিকটা খুনসুটি। ঘটিরা সেটা যেমন উপভোগ করে, বাঙালরাও তাই। ওদের গেঁড়িগুগলি তো আমাদের কচু ঘেঁচু , ওদের নুচি নেবু নঙ্কা তো আমাদের বেঙ আর ভ্যাক। ওরা বলে ওরে লোটা, আমরা ডাকি ওরে মাচা। আমাদের পূর্ব প্রজন্ম যারা প্রথম এখানে বসবাস করা শুরু করে তাদের লড়াই আজ শেষ। তাদের একমাত্র আশা ছিল "আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে"। দুধে ভাতে না থাকলেও, প্রতিদিন প্রাণের ভয় আজ আর নেই। আমাদের প্রজন্ম বড় হয়েছে ঘটি বাঙালের মিলমিশে। কিন্তু নিজের পরিচয় দিতে গেলে বাঙাল পরিচয়টা আপনা থেকেই চলে আসে। আমাদের সেটুকু দায়বদ্ধতা রয়ে গেছে আগের প্রজন্মের প্রতি। তাই শুঁটকি খাই বললে লোকে যখন নাক কুঁচকে জিজ্ঞেস করে কোথাকার বাঙাল, বুক ফুলিয়ে বলতে পারি চাটগাঁ। ছোটবেলায় পিসি জোর করে নিয়ে যেত চট্টগ্রাম পরিষদের অনুষ্ঠানে। তখন মনে হতো এসব কিম্ভূত ব্যাপারে আবার কেন, কোথায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেব না এখানে হ্যাজাচ্ছি। কিন্তু আজ ভাবলে মনে হয় সেটা আসলে ছিল অনেকটা রীলে দৌড়ের মতো, আগের প্রজন্মের হাত থেকে আমাদের হাতে মশালটা ধরিয়ে দেয়া।
তাই বলে ঘটি আর বাঙাল যে ভাই ভাই এক ঠাইঁ তা নয় এখনো। খেলার মাঠে গালিগালাজ ইঁট পাটকেল এখনো পড়ে, কিন্তু ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান এখন আর ঘটি বাঙালদের যুদ্ধ নয়। অনেক বাঙালই মোহনবাগানকে সমর্থন করে, আবার অনেক ঘটি ইস্টবেঙ্গলকে। আর সেই লড়াইটা এখন খানিকটা প্রতীকী। তবু অনেক সময় অতি উৎসাহে মাত্রা ছাড়িয়ে যায় শালীনতা। অনেক সময়ই ঘটি বাঙাল বাগবিতণ্ডায় গা জ্বলে উঠেছে অপমানে, যোগ্য জবাব দিয়ে তবেই মন হয়েছে শান্ত। তারপর মাথা ঠান্ডা হলে ভেবে দেখছি যে গোটা ব্যাপারটাই কি অপ্রয়োজনীয়। আর ঠিক সেই অনুভূতিই হলো যখন দাদাগিরির খবরটা পেলাম।
প্রথমে ফেসবুকে পড়ে কিছুই বোঝা গেলোনা কি হয়েছে। আস্তে আস্তে পুরো ব্যাপারটা বিস্তারে বোঝা গেলো যে শোতে গোটা বাঙালদের অপমান করা হয়েছে। অনেক খুঁজেপেতে ইউটিউবে একটা ছোট ক্লিপ পেলাম যেখানে দাদা বলছে (বাঙালরা) পাঁচিল টপকে টপকে এসেছে? আর বৈদ্যুতিন মাধ্যমে চলেছে রাগ দুঃখ অভিমানের পালা। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম একটা সম্পূর্ণ ক্লিপ গোটা অনুষ্ঠানটার। অবশেষে দেখলাম কি সেই অতি কুরুচিকর প্রোগ্র্যাম।
কিন্তু যা দেখলাম তা তো যা পড়লাম বিভিন্ন জায়গায় তার সাথে খুব একটা মিললনা! হ্যাঁ ওই সৌগত ঘোষ লোকটা খুব গা জ্বালানো ভঙ্গিতে বাঙালদের নিয়ে কটূক্তি করেছে বটে, কিন্তু তার সাথে সৌরভকে টানার খুব একটা যুক্তি চোখে পড়লোনা। বরং দেখলাম অনুষ্ঠানের শুরুতেই দাদা বলছে ইস্টবেঙ্গল ঢুকলো ভালোভাবে কিন্তু মোহনবাগান হোঁচট খেলো কেন? আর ওই পাঁচিল টপকে এসেছে মুহূর্তটায় গিয়ে দেখলেও চোখে পড়বে যে ইস্টবেঙ্গলের অনিন্দ্যবাবু যথার্থ জবাবই দিয়েছেন। গোটা অনুষ্ঠানে তিনি দারুন টেম্পেরামেন্ট দেখিয়েছেন, নিচু রুচির খেউড় করে লোক হাসানোর চেষ্টা করেননি। মোহনবাগানকে স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রণী ভূমিকার জন্যে ধন্যবাদ দিয়েছেন, তেমনি মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি যে ১৯১১ সালের রেঞ্জার্সকে হারানো দলের সাত জনই বাঙাল ছিল। পাঁচিল টপকে আসার কমেন্টে সৌরভ মোহনবাগান প্রার্থীর কথা বলার ভঙ্গিতে হেসেছে ঠিকই কিন্তু সেটাকে সব ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা যেভাবে বাঙালদের অপমান করার সমর্থন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে, ব্যাপারটা আদপে সেরকম কিছুই নয়। সৌরভকে ক্ষমা চাইবার দাবি তো যথাযথ নয় একদমই। সৌরভ গাঙ্গুলী যথেষ্ট দক্ষ ভাবে গোটা অনুষ্ঠানটা সঞ্চালন করেছে। আর বাঙালরা হার না মানার আরেক নাম। এই সব ঠুনকো সমালোচনাতে যদি গায়ে ফোস্কা পড়ে এখন, তাহলে বলতেই হয় সেটা খুব একটা বাঙাল সুলভ আচরণ নয়। নানা অজুহাতে কাঁদুনি গায় তো মোহনবাগান। আমরা ওদের দোলে কবে থেকে ভিড়লাম?
তবে যদি ধরে নেন এ লেখা পরে যে সৌরভের অন্ধ ভক্ত আমি, তাই তার সাতখুন মাফ, সেটা বিন্দুমাত্রও সত্যি না। খেলোয়াড় সৌরভকে যথেষ্টই ভালো লাগতো, কিন্তু তার সাথে মানুষ সৌরভের যে অনেকটাই ফারাক সেটা বহুদিন আগে থেকেই খেয়াল করেছি। সৌরভ যে আদপে ক্ষমতার দাস সেটা বিগত কয়েক বছরে মাঠের বাইরে সৌরভের কীর্তিকলাপ দেখলেই নজরে পড়ে। পুরসভা নির্বাচন, সিএবি সচিব নির্বাচন, ডালমিয়াকে সরানো, আবার তার ছেলের হাত ধরেই সিএবিতে ফেরা, ক্রিকেট একাডেমির জমি, পার্ক স্ট্রিটে রেস্তোরাঁ - অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য আর ক্ষমতার অলিন্দের হাতছানি যে সৌরভকে চিরকাল প্রভাবিত করে এসেছে তা নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই। খেলোয়াড় এবং ভারতের অধিনায়ক সৌরভ যতটাই অনুপ্রেরণা জাগায়, মাঠের বাইরের সৌরভের এই অন্যরূপ দেখে মনে হয় যে সেই অন্য সৌরভের ব্যক্তিত্বের বিন্দুমাত্রও এই মানুষটার মধ্যে নেই। তাই পাঁচিল টপকে আসার বিষয়ে সৌরভকে অকারণে সমর্থন করার কোনো কারণ আমার নেই।
আমার বক্তব্য হলো ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান স্পেশাল এপিসোডে দু পক্ষই যে একে উভয়কে নিয়ে কিছু না কিছু বলবে সেটাই প্রত্যাশিত। ক্ষমা যদি চাইতেই হয়, সেটা চাইবার কথা যে ওই মন্তব্য করেছে সেই সৌগত ঘোষের। অনিন্দ্যবাবু শালীন ভাবে জবাব দিয়েছেন যে সীমান্তে পাঁচিল কোনোকালে ছিলোনা যে পাঁচিল টপকে আসতে হবে। বাঙালরা এসেছে ভারত সরকারের তত্ত্বাবধানে। সৌরভকে কাঠগড়ায় তোলার মতো অপরাধ হয়নি কিছু। তার মানে কি জবাব নেই বাঙালদের খোঁচা মারা টিপ্পনীর? আছে বৈকি। কিন্তু সে জবাব হবে মাঠে। তার চেয়ে বড় জবাব আর কিছু হয়না। কারন যতবার ডার্বি, মাচা তোরা হারবি। এ তো কথায়ই আছে।
পুনঃশ্চ: এই লেখাটা কিন্তু ঘটি বাঙাল নির্বিশেষে লেখা। ইস্টবেঙ্গল মানে আর ওপার বাংলা নয়, যেমন মোহনবাগানও আর কেবল ঘটিদের ক্লাব নয়। এই গোটা ঘটনাটার সূত্রপাত কিন্তু বাঙালদের নিয়ে। তাই লেখার মূল উদ্দেশ্য বাঙালদের সৌরভকে লক্ষ্য করে মুন্ডপাতের দাবির যথার্থতা নিয়ে। অনেক জোগাড়যন্ত্র করে ভিডিওটা জোগাড় করেছি। লিঙ্কটা দেয়া রইলো, অনুগরোগ করে দেখুন, আর তারপর বিচার করুন সৌরভ অনুষ্ঠানে মোহনবাগানের হয়ে পক্ষপাতিত্ত্ব করেছে কিনা।
1 comment:
شركة المثالية لتنظيف المنازل بسيهات
Post a Comment