Friday 13 October 2017

একটা গান, একটা গুলি, একটা ম্যাচ

একটা গান, একটা গুলি, একটা ম্যাচ

সব মানুষেরই জীবনে কিছু কিছু মুহূর্ত আসে যা সারা জীবনের মতো মনে দাগ রেখে যায়।  আমারও জীবনে সেরকম সময় বহু এসেছে যেগুলোর কথা মনে পড়লেই গায়ে শিহরণ জাগে। তা সে ময়দানে অন্ধকারে বান্ধবীর হাত ধরে পুলিশের গাড়ির তাড়া খাওয়া, বা চলন্ত বাসে হাত ফস্কে মনে হওয়া যে দুটো আঙুলের তফাৎ ঝুলে থাকা আর চাকার তলায় যাওয়ার মধ্যে, কিম্বা বন্ধুদের সাথে বাজী রেখে রেলব্রিজ পার হতে গিয়ে হঠাৎ বুঝতে পারা যে মালগাড়ি নয়, পেছনে আসা ট্রেনটা রাজধানী এক্সপ্রেস, এখনও চোখ বুজলেই সেই সময়গুলো এমন সজাগ হয়ে ওঠে যে মনেই হয়না আজ বহু বছর পার হয়ে গেছে।  মন চলে যায় ঠিক সেই মুহূর্তে যখন ঘটনাটা আদপে ঘটেছিল। অগুন্তি সেসব স্মৃতির মধ্যে সবার প্রথমে যেটা মনে আসে সেটা ছিল এক বসন্তের বিকেল। সেদিন ছিল খানিকটা বিরহ, খানিকটা উত্তেজনা খানিকটা কলজে খাঁচাছাড়া আর বাকী সময়টা বিx টাকে করে বাড়ি ফেরা - রোমাঞ্চের সব সরঞ্জামই মজুদ ছিল সেদিন। 

সন তারিখ অক্ষরে অক্ষরে মনে নেই, তবে সেটা খুব সম্ভব ছিল ১৯৮৬ কি ৮৭ সাল।  মানে আমি তখন কি ৮। বার টা মনে আছে খুব, সেটা ছিল শনিবার। বাবার হাফ ছুটির দিন, তার মানে দুপুরে বিবিধ ভারতী শুনে ৩টেয় বাবা বাড়ি ফিরলে বাবুঘাটে বেড়াতে নিয়ে যাবে জাহাজ দেখাতে।  শনিবার বিবিধ ভারতীতে সিনেমার গান শোনার ছাড় ছিল। বাবা বাড়ি আসার ঠিক আগে কি পরে একটা গান চালালো, পরে জানতে পেরেছিলাম যে সেটা আশা ভোঁসলের গাওয়া ত্রয়ীর গান। "কথা হয়েছিল তবু কথা হলনা, আজ সবাই এসেছিলো শুধু তুমি এলেনা" গানটা শুনেই কেমন মন খারাপ হয়ে গেলো।  তারপর বসন্তের বিকেল বলে কথা।  কথায় কথায় বাবা বললো সল্টলেকে ফুটবল খেলা নিয়ে নাকি ঝামেলা হয়েছে, পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে।  তখন বাওয়াল, ক্যালানো এসব জানতামনা তাই আলুনি ভাষাতে বুঝলাম ইস্টবেঙ্গল মহামেডানের ফুটবল ম্যাচ ছিল সল্টলেকে। মহামেডান নাকি - গোলে জিতছিলো রেফারি ভুল পেনাল্টি দিয়েছে তারপর স্কোর -৩। মহামেডান সাপোর্টাররা (হ্যাঁ তখন ফ্যান মানে সিলিং ফ্যান টেবিল ফ্যান আর ভাতের ফ্যানই বুঝি, সমর্থকের মানে তখন সাপোর্টার) ভাঙচুর চালানোর চেষ্টা করেছিল, পুলিশ বেদম পিটিয়েছে আর দুটো ব্লকের মধ্যে দেয়াল থাকায় তারা পালাতে পারেনি ডান্ডার বাড়ি থেকে। ঝামেলা টামেলা তখন বুঝিনা তেমন, ইস্টবেঙ্গল ড্র করেছে সেটা শুনেই মনটা ভালো হয়ে গেলো।

বাবার খাওয়া হয়ে গেলে আমরা বেরোলাম বাড়ি থেকে।  তখন সবে - বছর হলো এসেছি কলকাতায়, গঙ্গার ধারে বেড়াতে যাওয়া আমার একমাত্র রিক্রিয়েশন। পাড়ায় অনেক ছেলে থাকলেও আমি বেরোতাম না বিকেলে বাড়ি থেকে। রান্না ঘরের জানলা থেকে দাঁড়িয়ে তাদের খেলা করা দেখতাম।  আসলে প্রথম - বছর আমার বন্ধুর সংখ্যা ছিল ১। কলকাতায় ওই দঙ্গলে যোগ দিতে আমার  কিছু বছর লেগেছিলো। কৃষ্ণনগরে থাকতে পাগল ছিলাম ট্রেন দেখার জন্যে। কলকাতায় এসে তার সাথে জুড়লো জাহাজ দেখা। তখনও কলকাতা ডকে বড়বড় জাহাজ নোঙ্গর ফেলতো, গঙ্গা তখনও পুরো মরে যায়নি। গঙ্গার ধারে বাবুঘাট প্রিন্সেপ ঘাট ফেয়ারলী প্লেস আর যে যে ঘাটগুলো আছে, সেখানে সিঁড়ি বেয়ে ইঁটের খিলানগুলোর নিচে দাঁড়িয়ে জাহাজ দেখার অভিজ্ঞতা অদ্ভুত। জোয়ারের সময় সে সব সিঁড়ি জলের নিচে চলে যেত, কিন্তু ভাঁটা হলে সেই খিলান পার হয়ে জলে গিয়ে দাঁড়ালে যেন মনে হতো নদীর মাঝে চলে এসেছি। চোখের সামনে বিরাট বিরাট জাহাজ, আর বড় বড় বয়া জলে ভেসে থাকতো জাহাজ নোঙ্গর করার জন্যে। তার পিছনে শেষ বিকেলের সূর্য যখন অস্ত যেত, সে দৃশ্য মনে ধরে উদাস হয়ে যাবার বয়েস তখনও হয়নি, আর স্মার্টফোনের যুগও সেটা ছিলোনা যে টকাটক ছবি তুলে রাখবো। তার বদলে খুঁজতাম জাহাজগুলো কিরকম দেখতে, কত তলা উঁচু কেবিন, কটা চিমনি, জাহাজের কি নাম। আমার মেজোমামা ছিল জাহাজী, সেই সূত্রে জাহাজ মানেই ছিল অন্য একটা পৃথিবী, যা শুধু বইয়ের পাতায় আটকে ছিল তখনও।

যাক মূল ঘটনায় ফেরা যাক। বেলা ৩টে নাগাদ সেজেগুজে বাবার হাত ধরে বেরিয়ে পড়লাম বাস স্ট্যান্ডের দিকে। খানিক দাঁড়িয়ে থাকার পর কমলা রঙের ৩৯ আসতে দেখেই বুঝে গেলাম যে বাবাই-পুকাই আসছে। মানে বাসের গায়ে ওই নাম লেখা ছিল। স্কুল থেকে ফিরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাস দেখতাম রোজ, তখন বাড়িঘর অত হয়নি, বাসের রঙ দেখে বলতে পারতাম ৩৯ না ৪২এ। বাবাই পুকাই কে ছিল জানিনা, হয়তো বাস মালিকের দুই ছেলের নাম। পেছনের দরজা দিয়ে বাসে উঠে কাটা সিট পাওয়া গেলোনা, তাই লম্বালম্বি জেন্টস সিটেই বসে পড়লাম যেখানে সিটের নিচে পেছনের চাকা। কাটা সিটগুলোর জন্যে হাপিত্যেশ করে বসে থাকতাম কারণ বাইরেটা দেখতে হলে ঘাড় ঘুরিয়ে সারাটা পথ যেতে হয়না। বাস যথারীতি নিয়ম মেনে এগিয়ে চললো আমাদের কুষ্টিয়ার বাসস্টপ থেকে। কুষ্টিয়া থেকে পার্কসার্কাস অবধি রাস্তায় কখন কোথায় রয়েছি তার জন্যে বাইরে তাকিয়ে থাকতে হতোনা তখন। মোড় ছাড়িয়ে প্রথমে নাকে আসতো রাসবাড়ির মাঠে চরা মোষের গন্ধ আর রাস্তার পাশের নর্দমা থেকে আসা গোবরের গন্ধ।  তারপর বন্ডেল রোড থেকে মোড় ঘুরে ক্যালকাটা কেমিকেলের বিভিন্ন রাসায়নিকের গন্ধ, তাতে ফিনাইল সাবান ডিটারজেন্ট সবই মিলেমিশে গেছে। তারপর আবার বার দুই বেঁকেচুরে রাস্তা শেষে পৌঁছায় লোহাপুলে। সেখান থেকে নম্বর ব্রিজ অবধি ছিল ট্যানারি, তার যা গন্ধ নাড়ি উল্টে আসার জোগাড়। আর জানলা দিয়ে চাইলে দেখা যেত সারিসারি খাটালের মতো কাঠামো, সেখান থেকে গরু বা মোষ ঝুলছে আর নর্দমাগুলো একটা কমলা আর বাদামির মাঝামাঝি রঙের তরলে ভর্তি। বাস সেই নম্বর ব্রিজের পাশ দিয়ে গিয়ে শেষে বেঁকে ব্রিজের ওপর উঠলে তবে সে গন্ধ যেত। সেদিনও সেই পুরোনো রুটিনের কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। হয়না মানে ৪নম্বর ব্রিজ অবধি। আসল ঘটনার এখানেই সূত্রপাত।

৩৯ নম্বর বাস সাধারনত ৪নম্বর ব্রিজের শেষে দাঁড়াত। সেখান থেকে বাঁক নিয়ে ব্রিজের ওপরে উঠে তারপর সোজা ব্রিজের অন্যপারে পরের স্টপ। সেদিন বাস সবে ঘুরে খানিক দূর এগিয়েছে হঠাৎ দেখি স্পিড কমিয়ে বাস একদম দাঁড়িয়ে গেলো। প্রথমে ভাবলাম কি ব্যাপার, ব্রিজের ওপর তো স্টপ হয়না। কেউ কি হাত দেখিয়েছে দাঁড়ানোর জন্যে? এসব সাত পাঁচ ভাবছি এমন সময় বেশ হইহল্লা শুরু হয়ে গেলো ড্রাইভারের সিটের দিক থেকে। বাইরে তাকিয়ে দেখি বেশ কিছু লোক হাতে ইঁট তলোয়ার এসব নিয়ে বাসের দরজায় হাজির। একজন হাঁক মারলো, তাড়াতাড়ি সব বাস খালি করে দাও, বাস জ্বালানো হবে।

জ্বালানো হবে মানে? খবরের কাগজে দেখেছি বাস জ্বালানোর ছবি কিন্তু এভাবে চাক্ষুষ দেখতে হবে কখনো ভাবিনি। আমি এমনিতেই সারা জীবন ভীতু টাইপের, বাস জ্বালানোর কথা শুনেই আকাশপাতাল ভাবতে শুরু করলাম, আমাদের তারপর কি করবে? ধরে ঠ্যাঙাবে, মেরে ফেলবে? যদি কিছু না করে ছেড়েও দেয় হেঁটে হেঁটে বাড়ি যেতেও অনেক সময় লাগবে। বাবার কি হবে? জ্বালাবে কেন? না খেলার মাঠে যে ঝামেলা হয়েছে সেখানে প্রচুর মহামেডান সাপোর্টার মার্ খেয়েছে, এখন পার্কসার্কাসের মহামেডান সাপোর্টাররা তার বদলা নেবে। তখনও ধর্ম, রাজনীতি এসব ব্যাপারে তেমন ধারণা হয়নি, আর কলকাতা লীগে তার প্রভাব কেমন ছিল তাও জানা নেই। তবে মহামেডান সমর্থক মানেই যে মুসলমান সেটা সত্যি বলে মনে হয়না। খানিকটা অবাকই হয়েছিলাম সল্টলেকে লাঠি খেয়ে পার্কসার্কাসে বাস জ্বালানোর মতলব দেখে। 

জীবনে এমন অনেক মুহূর্ত আসে যখন কোনও ঘটনা চোখের সামনে দেখে মনে হয় যেন সুপার স্লো রিপ্লে দেখছি, এক একটা সেকেন্ড যেন এক এক মিনিটের সমান। আমি যখন সাত পাঁচ ভেবে চলেছি কি হবে না হবে এসব নিয়ে, আর এক কন্ডাকটর সামনের দরজায় যারা ঘেরাও করেছে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছে, ঠিক সেই সময় অন্য কন্ডাকটর আর বাস ড্রাইভারের মধ্যে যে কি চোখের ইশারা হয়ে গেলো খেয়াল করতে পারলামনা, কিন্তু হঠাৎ দেখলাম কন্ডাকটর বলছে বাস ছাড়লেই জানলার পাল্লা তুলে দিয়ে সিটের নিচে বসে পড়তে। অন্য কন্ডাকটর তখন বাসে ফিরে এসেছে লোকজনকে নামতে অনুরোধ করতে। এমন সময়, যখন মনে হচ্ছে শর্মার গল্পের এখানেই ইতি, বাসটা ঘড়ঘড় আওয়াজ করে জ্যান্ত হয়ে উঠলো আর কন্ডাকটর দুজন সামনে পিছনের দুটো দরজা দিলো বন্ধ করে। এখন ৩৯ বাসের একটা ছোট ইতিহাস বলি, আমাদের তখনকার পিকনিক গার্ডেন এলাকার মতো ৩৯ বাসও কুখ্যাত। কত লোক যে চাপা পড়েছে ৩৯এর নিচে তার ঠিকানা নেই। আমাদের বাস ঘিরে খার খাওয়া লোকজন ইট পাটকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও ৩৯বাস যেই স্টার্ট দিয়েছে আদ্ধেক লোক ভ্যানিশ। পরের মিনিট সময়টা এখনও এতো পরিষ্কার মনে আছে যে এক এক সময় মনে হয় এই তো সেদিনের ঘটনা। 

বাস যেই চালু হলো, সামনে থেকে অমনি সব জনতা হাপিস, কিন্তু পেছন থেকে লোকজন শুরু করলো বাসের বডিতে বাড়ি মারতে, জানিনা লাঠি না কি ছিল। আমি এতো সব অ্যাকশনের মাঝে আড়ষ্ট হয়ে বসে রয়েছি এদিকে বাবা আমার সিটের পেছনের পাল্লা তুলে দিয়ে আমার ঘাড় ধরে সিটের নিচে বসিয়ে দিলো। বাস তো এগোতে শুরু করেছে এমন সময় বাইরে হাতের চাপড়, লাঠি এসবের মাঝে বাসের পেছনের চাকার ওপরে, ঠিক আমরা যেখানে বসে ছিলাম সেখানেই একটা বিকট আওয়াজ পেলাম। মনে হলো বাসের একটা দিক বুঝি ভেঙেই পড়লো। আমাদের বাস কিন্তু না থেমে এগিয়ে চললো, আর একটু এগিয়ে যখন ফুল স্পীডে ব্রিজের একদম মাঝে চলে এসেছে, তারপর আর সে বাস একদম সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেলো। তখনও জানিনা আবার কোথায় লোকজন ঘাঁটি বেঁধেছে বাস থামানোর উদ্দেশ্যে, তাই বাস থামাবার কোনও কথাই নেই। দরজা বন্ধ, জানলার পাল্লা তোলা, আমাদের বাস এগিয়ে চললো অনেকটা দুর্ভেদ্য ট্যাঙ্কের মতো। একে একে পেছনে রেখে এলাম পার্কসার্কাস ময়দান, পদ্মপুকুর, আনন্দ পালিত, মৌলালি। এসব স্টপেজে হয়তো কিছু লোকের নামার কথা কিন্তু গন্ডগোলের আশঙ্কায় তারাও আর বেশি উচ্চ্যবাচ্য করলোনা। প্রথম স্টপ সেই এসপ্ল্যানেড। বাস হুড়মুড় করে খালি হয়ে গেলো। আমরাও দোনোমোনো করে নেমে পড়লাম সেখানে। জাহাজ দেখতে যাওয়া তখন মাথায় উঠেছে, মানে মানে বাড়ি ফিরতে পারলেই হলো। আমাদের নামিয়ে বাবাই-পুকাই চলে গেলো হাইকোর্টের দিকে। এখনো মনে হয় সেদিন ওই ড্রাইভার ওরকম অতিমানুষিকভাবে বাস চালিয়ে আমাদের উদ্ধার না করলে জীবনটা আজ অন্যরকম হয়ে যেত কি?

তবে ওই বিকেলটা যেরকম আতঙ্কের সাথে শুরু হয়েছিল, শেষটাও হলো এক নতুন অভিজ্ঞতা দিয়ে। এসপ্ল্যানেডএর চত্বরে যেটা তখনও ট্রাম লাইনে ছেয়ে থাকতো, সেখানে দাঁড়িয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করলাম বাপব্যাটায়। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুনতে পেলাম যে পার্কসার্কাসের ঘটনাটা চারদিকে চাউর হয়ে গেছে, রাস্তায় বেশ কিছু পুলিশ। আবার ৩৯ ধরার কোনো প্রশ্নই নেই, আর অন্য কোন বাস যে বালিগঞ্জ ফাঁড়ি যাবে তাও জানা নেই। শেষে ঠিক করলাম ট্রামে চেপে বাড়ি ফিরবো। ২৪ নম্বর ট্রাম, মোমিনপুর আলিপুর হয়ে হাজরা মোড় বা বালিগঞ্জ স্টেশন। ট্রামে যখন উঠছি তখন বিকেল পড়ে আসছে। ফার্স্ট ক্লাসে একদম সামনের সিটদুটো পেয়ে গেলাম। ট্রাম চললো ময়দানের বুক চিরে, চারদিকে সবুজে ঘেরা রাস্তাঘাট ধরে। আলিপুরের দিকে যখন পৌঁছলাম তখন রাস্তায় এল জ্বলে গেছে। নিয়ন বা সোডিয়াম আলো তখন পিকনিক গার্ডেনে নেই, তাই প্রাণ ভরে দেখতে লাগলাম আলিপুরের গাছগাছালি, উঁচু দেয়ালের বাড়িঘর আর নিয়ন বাতির আলো-আঁধারি। নম্বর ব্রিজের ঘটনাটার মতো সেই আলো-আঁধারির ছবিটাও মনে পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নিয়েছে। অবশেষে হাজরা মোড় হয়ে, বন্ডেল গেট পেরিয়ে বাড়ি ফিরলাম -৮টার সময়।

একটা রহস্যের সমাধান তখনও হয়নি। তবে খুব বেশিদিন তার জন্যে অপেক্ষাও  করতে হয়নি। একদিন রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে দেখলাম বাবাই-পুকাই আসছে। বাসটা যখন আমাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে চলে যাচ্ছে তখন খেয়াল করলাম যে বাসের প্যাসেঞ্জার দিকের পেছনের দিকে, ঠিক যেখানে আমরা বসেছিলাম সে জায়গাটায় বাসের গায়ে একটা বড়ো জায়গা জুড়ে গোলমতো টোল। আর বাসের অ্যালুমিনিয়াম যদি যেমন চকচকে সাদা রঙ, সে জায়গাটা যেন কেমন একটা পোড়া পোড়া কালচে রঙ। ভাবলাম কেউ কি গুলি করেছিল বাসের দিকে তাক করে সেদিন?

তারপর তো কেটে গেছে বছরের পর বছর। আমাদের সেই ৮৬-৮৭র পিকনিক গার্ডেনও পাল্টে গেছে আস্তে আস্তে।নতুন বাড়িঘর, দোকানপাট। খাটালগুলো একে একে উঠে গেলো রাস্তার ধার থেকে। নতুন নতুন বাসরুট দিনের পর দিন। ক্যালকাটা কেমিকেলের বিচিত্র গন্ধগুলোও আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে গেলো। শুধু রয়ে গেলো বাবাই-পুকাইয়ের গায়ের টোলটা। বারান্দায় দাঁড়ালে প্রায়ই দেখা যেত বাবাই-পুকাই চলেছে তার গায়ের ক্ষতটা নিয়ে। আর সেই টোলটায় চোখ পড়লেই মনটা পিছিয়ে যেত বছরের পর বছর, ৮৬-৮৭র সেই বিকেলটায়। তারপর হঠাৎ একদিন বড় হয়ে গেলাম। চার বছর কাটালাম পাড়ার বাইরে। ফিরে এসে শুরু হলো চাকরি। আলসে বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাস দেখার শখ মিটে গেছে বহুদিন। তবু দেখা হয়েই গেছে। পাল্টে গেছে চেহারা, সামনের গ্রিলের রঙ কমলা নেই, তবু পেছনের চাকার ওপর টোলটা রয়েই গেছে। সারানো হয়নি গ্যারেজে গিয়ে নাকি ইচ্ছে করেই সারায়নি কে জানে। তারপর কখন একদিন থেকে আর দেখা নেই তার। কালের নিয়ম মেনেই বাবাই-পুকাই হয়তো চলে গেছে নতুন শ্যাসি নিয়ে, কিম্বা তাতুদার বাসের মতো বাবাই-পুকাইও রোদে জলে পুড়ছে কোথাও কোনো পুকুরের পাড়ে। কিংবা হয়তো আজও সে চলে পিকনিক গার্ডেন বাবুঘাট। ৮৬-৮৭র সেই বিকেলটার সাক্ষী আজ কেবল আমি। বাবাই-পুকাইয়ের গায়ের টোলটা কি সত্যিই গুলি ছিল? এখন ভালো করে খেয়াল করলে হয়তো দেখতাম গুলি না, হয়তো ছিল একটা থান ইঁট। কিন্তু গত তিরিশ বছর ধরে যা বিশ্বাস করে এসেছি, আজ তা নস্যাৎ করারও কোনো কারণ নেই। নাহয় সেই একটা দিনের স্মৃতি ঠিক তেমনিই রইলো যেমন এক আট বছরের আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম। হোকনা তার খানিকটা কল্পনা। দাগটা কি গুলির ছিল না ইঁটের

No comments: