Friday, 13 October 2017

কবসা

বিলেতে আসার পর এখানে খাবার দাবারের চল দেখে খানিকটা ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। রাস্তায় রাস্তায় আনাচে কানাচে "ইন্ডিয়ান" খাবারের দোকান, কিছু রেস্তোরাঁ কিছু টেক অ্যাওয়ে, রান্না হয়ে গেলে হয় বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায়, আর না হলে গিয়ে নিয়ে আসতে হয়। কিছুদিন পর জানলাম যে ইন্ডিয়ান খাবার দোকানগুলো আসলে চালায় বাংলাদেশিরা, তাদের বেশির ভাগের বাড়ি সিলেটে। আর ইন্ডিয়ান খাবার বলে যা চালায় সেগুলো খেতে দারুন হলেও কেমন যেন অন্যরকম। মানে নামে ভারতীয় হলেও স্বাদে নয়। যেমন একদিন ভাবলাম ভিন্ডি ভাজি খাই ভাত ডালের সাথে, তো ভিন্ডি ভাজি যা এলো সেটা হলো গোটা গোটা ঢ্যাঁড়স খানিক পেঁয়াজ শুকনো লঙ্কা দিয়ে ঝোল। যাক এতো বাঙাল রয়েছে ভেবে খানিকটা উৎসাহী হয়ে পড়ে ভাবলাম এরা রেস্তোরাঁয় মুরগি মটন চালালেও নিজেরা নিশ্চই রুই কাতলা ইলিশ পাবদা সাঁটায়। আব্দার করলে খুব সম্ভব আপ্যায়ন করে খাওয়াবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। তারা অতিথিপরায়ণ হলেও তেমন বাঙালি খাবার খায়না, রেস্তোরাঁয় যা হয় সে সবই খায়। ভারতীয় রেস্তোরাঁ যে নেই তা নয়, তবে হাতে গোনা, তার সুলুক সন্ধান না জানলে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মিল্টন কিনসে থাকার সময় খোলা বাজারে পেতাম ইডলি ধোসা এসব। আর মিল্টন কিনসে থাকার সময়ই দুর্গা পুজোয় ২ পাউন্ড প্রণামী দিয়ে পেট পুরে খিচুড়ি ভোগ বেগুনি আর রাতে পোলাও মাংস সাঁটিয়েছিলাম সে প্রায় ৭ বছর আগে। তারপর খোঁজ পেলাম লন্ডনে ওল্ড হ্যাম, ইস্ট হ্যাম আর নিউ হ্যামের। তামিল, মালয়ালি, পাঞ্জাবি খাবার ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁর মতো দামি নয়, তার সিকি কি আধা খরচে পেট পুরে খাওয়া যায় সেখানে। আর সেই লিস্টে শেষে যোগ হলো আরো দুটো জায়গা। প্রথমটা নিরামিষ, স্বামীনারায়ণ মন্দির লন্ডনে, আমার সাইট থেকে এক মাইল দূরে, আসা যাওয়ার পথে প্রায় প্রতি সপ্তায় ওই পথ দিয়ে যেতে হতো। কম পয়সায় দারুন খাবার, আর তার ওপর বুফে।  গুজরাতি নিরামিষ খাবার খেয়ে মাঝে মধ্যে আমার মতো ঘোর শাক্তও ক্ষনিকের জন্য ভাবতো এরকম খাবার পেলে নিরামিষাশী হয়ে যেতে আপত্তি নেই।  আর অন্যটা হলো সাউথ ইন্ডিয়ান খাবারের দোকান আমার অফিসের থেকে ১০-১৫ মিনিট দুরে।
এদিকে ভারতীয় হবার যা ঝক্কি এখানে, সবাই ভাবে সব ভারতীয়ই সঞ্জীব কাপুর, যে কোনো ইন্ডিয়ান খাবার চাইলেই তারা সেটা বানিয়ে ফেলতে পারবে, আর ভারতীয় খাবার মানেই বিরাট আয়োজন, পাতি পান্তা ভাত আর পেঁয়াজ কুচি ভারতীয় খাবার নয়। আবার গোটা কয় বন্ধু তাদেরকে যদি বলি শুঁটকি মাছ সাথে সাথে তাদের নাক কুঁচকে যায়।  তা সেই ভারতীয় খাবার রান্না করার তাগিদে বানিয়ে ফেললাম বেশ কিছু পদ বিভিন্ন সময়, তাতে আমার সহধর্মিনীর বিশেষ অবদান রয়েছে টেস্টার হিসেবে। সমস্যাটা হলো ভাত বা পোলাও কি বানাবো তাই নিয়ে। বাসমতি চালের পোলাও বেশ ভালোই হয় কিন্তু সেই গোবিন্দভোগ চালের পোলাওয়ের ধারেকাছে আসেনা তা। বিরিয়ানি বানানোর অশেষ ঝক্কি তার ওপর দুশ্চিন্তা রান্না হবে কিনা। বানিয়েছিলাম একদিন, স্লো কুকারে, ভালোই হয়েছিল কিন্তু রান্নার যা ঝামেলা হুট করে বানিয়ে ফেললাম তা নয়, প্রায় সারা দিন লেগে যাবে তোড়জোড় করতে করতে। এই অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেলো সমাধান। কবসা। এটা  পাকিস্তানী বা সৌদি রান্না, তবে গোটা মধ্য প্রাচ্যেই চল আছে, এর অন্য নাম হল মকবুশ। যে কোনো মাঝারি থেকে ঝাল মাংসের পদের সাথে খাবার জন্যে আইডিয়াল। আর এটা রান্না হতে যা সময় লাগে ভাত রাঁধতেও প্রায় একই সময় লাগে, শুধু প্রাথমিক যোগাড়যন্ত্রটুকু বাড়তি, আর তাও খুবই সামান্য। হলফ করে বলতে পারি যে ডাল আলুভাজার মত কবসাও এমন একটা পদ যেটা আমি বহুবার রেঁধেছি কিন্তু স্বাদে কোন তারতম্য হয়নি। 
রান্নার রেসিপির আগে "কিন্তু"টায় আসি। কবসার মূল উপাদানটা পাওয়া হয়তো তেমন সহজ নাও হতে পারে। এখানে নাম পাইন নাট, হিন্দি নাম চিলগোজা। এখানে একটু খুঁজলেই পাওয়া যায় সব বড় সুপারমার্কেটে। পাইন নাট না পেলে আখরোট বা কাঠবাদাম (Almond) ব্যবহার করা যেতে পারে কিন্তু এবেলা বলে রাখি স্বাদ একরকম না হবার দায় আমার রইলো না আর :)। 
উপকরণ যা যা লাগবে:
বাসমতি চাল ২ কাপ
চিকেন স্টক কিউব ২ তো বা চিকেন স্টক পেস্ট ২ চামচ
মাঝারি পেঁয়াজ ১ টা
রসুন ৬-৮ কোয়া
পাইন নাট ১/২ কাপ
মাখন ১/২ কাপ
জল ৪-৫ কাপ

প্রনালী

যদি চিকেন স্টক কিউব ব্যবহার করেন তো সেটা গরম জলে আগে থেকে ভিজিয়ে রাখতে হবে পুরোটা গুলে যাওয়া পর্যন্ত। পেঁয়াজ যত মিহি সম্ভব কুচি কুচি করে কেটে নিতে হবে। লম্বা জিরেজিরে নয়, অনেকটা ঝালমুড়ির পেঁয়াজের মত। চাল আগে ধুয়ে নেয়া যেতে পারে কিন্তু তাতে ফোটানোর জন্য জল কম দিতে হবে।  রসুন খোসা ছাড়িয়ে কুচি করে রাখতে হবে। রসুন বাটাও ব্যবহার করা যেতে পারে। আঁচে বড় কড়াই বসিয়ে পুরো মাখনটা গরম করতে হবে। পেঁয়াজ, পাইন নাট আর রসুন মাখনে সাঁতলাতে হবে ৫ মিনিট মত অথবা যতক্ষণ পুরো মিশ্রণটা হাল্কা বাদামী রঙ ধরছে। কড়াইতে পরিমাণমত জল আর চিকেন স্টক দিয়ে আঁচ বাড়িয়ে দিতে হবে জল ফুটতে শুরু হওয়া পর্যন্ত। জল ফুটলে চাল ছেড়ে দিয়ে আঁচ কমিয়ে কড়াই ঢাকা দিয়ে দিতে হবে। ব্যস আর কিছুই করার নেই, শুধু ১০-১৫ মিনিট মাঝে মাঝে চালটা নাড়িয়ে দিতে হবে যাতে তলা ধরে না যায়। চাল সেদ্ধ হয়ে গেলে আর জল মরে এলে কবসা তৈরি। যদি চাল সেদ্ধ হবার আগে জল শুকিয়ে যায় তাহলে কড়াইতে আন্দাজমত গরম জল দিয়ে দিতে হবে। জল প্রথমে বেশি দিলে ভাত গেলে যাবার সম্ভাবনা আছে, তাই শুরুতে একটু কম জল দিলেই ভাল। 

যদি চিকেন স্টক নিজে তৈরী করেন তাহলে কবসায় কিছু মাংসের টুকরোও ছেড়ে দিতে পারেন। আর মাখনের পরিবর্তে মার্জারিন ব্যবহার করতে পারেন যদি মাখনের পরিমান দেখে আঁতকে ওঠেন। কোনো মসলা ছাড়াই কবসা যথেষ্ট সুস্বাদু, তবু মসলার স্বাদ পেতে হলে অল্প জায়ফল জয়ত্রীর গুঁড়ো ছড়িয়ে দিতে পারেন ওপরে। পুরো রান্না হতে লাগবে ২০-২৫ মিনিট বড়জোর, আর পোলাওয়ের পিছনে আদ্ধেক বেলা কাটাতে হবেনা। চটজলদি অন্য ধরণের ভাতের জন্য চেষ্টা করে দেখুন কবসা।

No comments: